Breaking News

এখনও অভিশপ্ত চম্বল ঘাটি, ডাকাত নেই, কিন্তু রয়েছে কলঙ্কিত অধ্যায়ের কালো মেঘ

পূর্ণেন্দু ব্যানার্জি– চম্বল। নামটা শুনলেই যে শব্দটা সমগ্র ভারতবাসীর কাছে  বুলেটের মতো বিঁধে, তা হল ডাকাত। ভয়ঙ্কর ডাকাতদের গড়। কুখ্যাত ডাকাতদের  কাহিনি আজ হয়তো ইতিহাস। কিন্তু তার আতঙ্ক! এখনও কুরে কুরে গ্রাস করে পুরো চম্বল উপত্যাকা জুড়ে।

গব্বর সিং, পান সিং তোমর, মান সিং, ফুলন দেবী, রামবাবু গাদারিয়া, মোহর সিং, রমেশ সিং সিকরওয়ার, নির্ভয় সিং গুর্জর, ইংরেজ শাসনকাল থেকে ৯০ এর দশক পর্যন্ত এমন বহু ডাকাতের নামে কেঁপে উঠত পুরো চম্বল ঘাটি।  ডাকাতদের মধ্যেই হয়ে যেত ক্ষমতার হাতবদল।

পুলিশি এনকাউন্টারে একটা ডাকাত দল যখন খতম, তার জায়গা দখল করে নিত অন্য একটি দল।  শয়ে শয়ে হিংস্র, নির্মম ডাকাতের মৃত্যু হয়েছে চম্বল উপত্যকায়। এখন হয়তো অনেকটাই শান্ত কিন্তু আতঙ্কের আবহ কতটা বদলেছে?

চম্বল নদী। এক অভিশপ্ত নদী। এর উল্লেখ রয়েছে রামায়ণ ও মহাভারতে।  স্থানীয় এক বাসিন্দার মতে, রামায়ণের সূত্র ধরে একটা ছোট্ট ঘটনা বলা যেতে পারে। একবার শ্রবণকুমার তাঁর অন্ধ বাবা, মাকে নিয়ে কাঁধে ডুলি করে তীর্থে নিয়ে যাচ্ছিলেন। শ্রবণকুমার ছিলেন বাবা মায়ের পরম ভক্ত সন্তান। কর্তব্য ছাড়া কিছুই বুঝতেন না। অন্ধ বাবা মাকে তীর্থের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন বলে, নিজেই ডুলি করে বাবা মাকে নিয়ে ঘুরতেন।

একবার এই চম্বল নদীর তীরে তিনি এসে পৌঁছন।  নদীর পাড়ে বাবা মায়ের ডুলি রাখার পরে, নদী থেকে জল পান করে বিশ্রাম নেন।  এর পরেই ডুলি তোলার সময় তাঁর মনে হতে থাকে।  তিনি এ কী করে যাচ্ছেন সারা জীবন! তাঁর একটা ভবিষ্যত রয়েছে, সেসব ছেড়ে দিয়ে বাবা মাকে কাঁধে করে এতো কষ্ট করে তীর্থ করিয়ে যাচ্ছেন।

শ্রবণ কুমার বাবা মাকে বলেন, পিতা ও মাতা, আপনাদের বোঝা আর বইতে পারছি না। আমাকে মুক্তি দিন।  আপনারা এই নদীর পাড়েই থেকে দেহত্যাগ করুন।  আমি আর কষ্ট করতে পারছি না।

পিতা বলেন, সবই বুঝি বাবা, তোমার কষ্ট বুঝতে পারছি, কিন্তু দয়া করে এই নদীটা পার করে, অন্য পাড়ে গিয়ে, কোনও সুরক্ষিত গাছের তলায় আমাদের ছেড়ে যেতে পারো।  এখানে ছেড়ে যেও না।  পিতার অনুনয় রাখলেন, আবার কাঁধে তুলে নদীর অন্য পাড়ে  এসে ডুলি নামালেন শ্রবণকুমার।

কিন্তু ডুলি নামানোর পরেই তার প্রবল অনুশোচনা হল।  তিনি সঙ্গে সঙ্গে বাবা মায়ের কাছে ক্ষমা চাইলেন, বললেন, আমি জানি না, কী হয়েছিল, আমার মতিভ্রম হয়েছিল, আমি এমন একটা কথা বলে ফেলেছি। তিনি কেঁদে বাবা মায়ের কাছে আবার ক্ষমা চাইলেন।  অর্থাত বাল্মীকি রামায়ণে এই নদীর নেগেটিভ শক্তিকে বর্ণনা করেছিলেন।

বিহড় (মাটির গিরিখাত)

কাহানি রয়েছে মহাভারতেও, মহাভারতের সভা পর্বে পাশা খেলার স্থান নির্বাচিত করেছিলেন স্বয়ং শকুনি। সেই সময় গান্ধার নরেশের শকুনির সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল চম্বল নদীর একপাড় পর্যন্ত।  সেখানে পাশা খেলা হয় এবং পাণ্ডব হারে।  দ্রোপদীকে তুলে এনে এখানে ভরা সভার মধ্যে তাঁর বস্ত্রহরণ করা হয়।  সেই সময় এই চম্বল নদীকেও অভিশাপ দিয়েছিলেন, বলেছিলেন, দেশের অন্য নদীর পাড়ে, যেভাবে সমৃদ্ধ সভ্যতা গড়ে ওঠে, তোমার পাড়ের নগর সভ্যতা ধ্বংসের মেঘ বয়ে আনবে। কোনও দিন সমৃদ্ধ হবে না।

আজকের আধুনিক বিজ্ঞানের যুগে, অভিশাপ শব্দের হয়তো কোনও মূল্য নেই।  কিন্তু বাস্তব চিত্র বলছে, যেন সেই শব্দবন্ধকে আজও জীবীত করে রেখেছে সমগ্র চম্বল নদীর পাড় জুড়ে। দেশের মধ্যে দূষণমুক্ত নদীর মধ্যে অন্যতম চম্বল।  তবু এই নদীকে পুজো করা হয় না। গঙ্গা, যমুনা, সরস্বরী, গোদাবরী, কাবেরী এদের সঙ্গে নামও উল্লেখ করা হয় না। 

আর এই নদীর পার্শ্ববর্তী পাড়, যেখানে সমৃদ্ধি বয়ে আনতে পারতো, সেখানে কয়েক লক্ষ হেক্টর জমি হয়তো দ্রোপদীর অভিশাপেই বিহড়ের জন্ম দিয়েছে।  চম্বল নদীর বুকে চরে বেড়ায় ঘড়িয়াল আর হিংস্র কুমীর। আর দুইপাড়ে শোনা যায়, ভয়ঙ্কর ডাকাতদের পদধ্বনি ও বুলেটের শব্দ।

রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ ও উত্তরপ্রদেশ তিন রাজ্যের সীমানা ছুঁয়ে ৯৬৫ কিলোমিটার বয়ে গিয়েছে চম্বল নদী।  উত্তরপ্রদেশের ইটাওয়া জেলায় চকরনগরে চম্বল মিশেছে যমুনার সঙ্গে।  আর মধ্যপ্রদেশের ভিন্ড জেলায় মিশেছে পাঁচ নদী, কুঁয়ারী, পহুজ, সিন্ধু, যমুনা, চম্বল।  এই পঞ্চনদই যেন চম্বল উপত্যকায় শতাব্দী ধরে চলতে থাকা পাঁচ অপরাধের ধারাকে বাহিত করে।

https://www.youtube.com/watch?v=ILuuqgMlQnU

সময়টা ১৮৫৭, সিপাহি বিদ্রোহ শুরু হল, যদিও এক বছরের মধ্যেই তা দমন করতে সফল হল ব্রিটিশরা।  সেই সময়ই চম্বল উপত্যকায় শাসক শ্রেণির বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিল চম্বলের একটা অংশের মানুষ। গভীর জঙ্গল আর বিহড়ের মধ্যে দল তৈরি করে কার্যত যুদ্ধ ঘোষণা করতে লাগলেন। নাম হল ‘বাগী’ বা বিদ্রোহী। 

চম্বলের বুকে যত জল গড়ায়, বদলাতে থেকে বাগীদের চরিত্র,  অপরাধের আঁতুড়ঘরে জন্ম নেয় ‘রঞ্জিস’ জাতিগত বিবাদ। না শুধু উঁচু জাতির বিরুদ্ধে নীচু জাতির লড়াই নয়। দলিতদের সঙ্গে ঠাকুর। ঠাকুরদের বিরুদ্ধে ঠাকুর, ব্রাহ্মণদের বিরুদ্ধে ব্রাহ্মণ। নীচু জাতির সূচনা হয় ফুলনদেবীর হাত ধরে।  ক্রমে আরও রূপ বদলায় চম্বলের অপরাধ জগতে।

ফুলনদেবী

এক অদ্ভুত বাঁক নেয় নদীর মতোই, নতুন ছক আমদানি হয়, ‘পকড়’ বা অপহরণ। গ্রামের উচ্চবিত্তরা যখন নিজেদের অর্থ, সোনার গয়না ব্যাঙ্কের লকারে রাখতে শুরু করলো, তখনই শুরু হল অপহরণের খেলা। শিশু থেকে মহিলা ও ব্যবসায়ী।  চম্বলের ঘাঁটিতে বসেই, খাস দেশের রাজধানী দিল্লি ও মুম্বই, কলকাতা পর্যন্ত জাল বেছানো থাকতো।

অপহৃত ব্যক্তি পৌঁছে যেত চম্বলের ঘাঁটিতে। কান টানলে যেমন মাথা আসে, তেমন পকড় বা অপহরণেই পুরো মালিকের ঘাঁটিতে পৌঁছে যেত টাকা।  আশির দশকেই চম্বলের বাগী চরিত্র বদলে  পকড় এক লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়।  যা এক চূড়ান্ত রূপ নেয় নির্ভয় গুর্জরের হাত ধরে।

তাঁর আমলেই গোটা ভারতবাসী চম্বলের ডাকাতের আরও এক মোহময়ী রূপ দেখতে পায়। তা হল দস্যু সুন্দরী।  সুন্দরী তন্বী যুবতী ডাকাতদের দেখা গেল নির্ভয়ের দলে। 

নির্ভয়ের হাত ধরে ‘পকড়’ ব্যবসা আরও এক নতুন রূপ নিল, ‘বড়া সিক্কা’। চম্বল উপত্যকার প্রায় ২০০টি গ্রামের একছত্র আধিপত্য বিস্তার করেছে নির্ভয় গুর্জর।  তার শরণাপন্ন হতে লাগলো, স্থানীয় নেতা, পুলিশ, আমলারা।  ভোট এলেই একটাই নাম নির্ভয় গুর্জর। তাঁর কাছে যে ভেট বেশি দেবে, চম্বলের এলাকা ভিত্তিক ভোট তার দিকেই যাবে। তার ফরমানকে অস্বীকার করা মানে মৃত্যু।

নির্ভয় গুজ্জর

নির্ভয় যার নাম ঘোষণা করতো, তার বিপক্ষে কেউ দাঁড়ানোর সাহস পেত না।  বড়া সিক্কা ফর্মুলা বেশ ভালোই চলছিল, কিন্তু একটা সময় আসে, তারও রূপ বদলায়।  যদিও সেই রূপ বদলের ধারা এসেছিল ফুলনের হাত ধরেই। তা হল ‘সেবা’ চম্বলের অপরাধ জগতের অন্তর্জলি রূপ।

ফুলনদেবী অস্ত্র ছেড়ে, জেল খেটে সরাসরি রাজনীতির ময়দানে নামেন। আর এই রাস্তা বহু ডাকাতদের কাছেই বেশ গ্রহণীয় হয়ে ওঠে। যদিও সবার ভাগ্যে সেই শিকে ছেঁড়েনি।  কেউ কেউ, গ্রামপঞ্চায়েত ও বিধায়ক স্তরেই জায়গা পেয়ে ক্ষান্ত থেকেছেন, যদিও ভোটের সময় প্রচ্ছন্ন বন্দুকের নলের দাপট ছিলই।

প্রায় ১৫০ বছর ধরে চম্বল নদীর বুক দিয়ে বয়ে গিয়েছে বহু জল। বহু বাগী, ভয়ঙ্কর ডাকাত পুলিশের গুলিতে মারা গিয়েছে। ভয়ঙ্কর যুদ্ধক্ষেত্রে বিহড়ের মাটি লাল হয়েছে বহুবার।  মাটির ঘন টিলা ও ঝোপ জঙ্গলের চোরাগলি, পার করে বহুজন মূলস্রোতের গান্ধীবাদী অহিংস রাজনীতিকে হাতিয়ার করে ক্ষমতা অলিন্দে পৌঁছে গিয়েছেন। কিছুজন ছুঁয়ে ফেলেছেন দিল্লির মসনদ।

কিন্তু এলাকার মানুষের কোনও উন্নতি হয়েছে? বলা বাহুল্য, না। সেখানে এখনও হয়তো দ্রোপদীর অভিসম্পাত  বেঁচে রয়েছে। আর চোরা স্রোতে অপরাধের এক ভিন্ন রূপ হয়তো জন্ম নিচ্ছে।  সবার অন্তরালে। আর তার ইঙ্গিত মিলছে, বিহড়ের মাটিতেই।  আজ থেকে ১০-১৫ বছর আগে যে জমি কৃষকরা চাষ করতো, সেই জমি হারিয়ে যাচ্ছে।

না কেউ দখল করে নেয়নি। নদীর গর্ভেও চলে যায়নি।  দেনার দায়ে কেউ বিক্রি করতেও বাধ্য হয়নি।  আসলে চাষযোগ্য জমি, ধীরে ধীরে পরিণত হয়ে যাচ্ছে বিহড়ে। মাটির গিরিখাতে।  গ্রাম ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন অনেকে।  এ এক অদ্ভুত প্রকৃতির প্রতিশোধ।  

আমাদের ফেসবুক ফলো করতে এখানে ক্লিক করুন

আমাদের চ্যানেলে যুক্ত হয়ে যান

About Orbit News

Check Also

উত্তরাখণ্ডের পঞ্চ বদ্রি: ভগবান বিষ্ণুর পবিত্র পাঁচ ধাম

উত্তরাখণ্ডের হিমালয়ের কোল জুড়ে ছড়িয়ে থাকা পাঁচটি পবিত্র বদ্রি মন্দির – বদ্রীনাথ, যোগধ্যন বদ্রি, ভবিষ্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!