Breaking News

এক মহাকেলেঙ্কারির গল্প, বিশ্বাসের তেল যখন তেলাপোকা

স্বাতী চ্যাটার্জি হেডিং দেখে আপনারা অনেকেই ভাবছেন, তেলের সঙ্গে তেলাপোকার সম্পর্ক কী? তাহলে মন দিয়ে পুরো প্রতিবেদন পড়তে হবে। আর বুঝতে হবে, দেশ কোথায় যাচ্ছে, আমরা কোথায় যাচ্ছি। উচ্চ শিক্ষা নিয়েও আমরা আসলে কাদের পদতলে থাকতে বাধ্য হচ্ছি, কেন হচ্ছি?

তেল এক মহার্ঘ্য উপাদান। খনিজ কাঁচা তেল আমাদের দেশে আমদানি করতে হয়। কখনও কম মূল্য দিয়ে কখনও, বেশি মূল্য দিয়ে। অর্থনীতির পরিভাষায় যে পণ্যের সাপ্লাই কম, অথচ চাহিদা বেশি, সেই পণ্যের মূল্য বেশি। আবার যে পণ্যের চাহিদা কম অথচ সাপ্লাই বেশি, তার দাম কম।

কিন্তু যবে থেকে সারা বিশ্বের তেল নির্ভর জীবনযাত্রা গড়ে উঠেছে, তবে থেকেই পণ্য হিসেবে বড় প্লেয়ার হয়ে উঠেছে এই তেল। জীবনযাত্রায় গতি আনতে, সম্পর্কে জেল্লা দিতে, বৈভবে মাধুর্য আনতে যেমন প্রতীকি তেল প্রয়োজন তেমনই, তেল বিনা গতি নেই।

দুর্ভাগ্যের বিষয় এক সময় অখণ্ড ভারতে যে ভান্ডার ছিল, তা হল, ফসল, শিক্ষা, শিল্পসংস্কৃতি, অনুশাসনযুক্ত জীবন যাত্রা এবং দীর্ঘ অভিজ্ঞতালব্ধ চিকিত্সাশাস্ত্রের ভান্ডার। কারণটা স্পষ্ট- দিনের শেষে মানুষকে খেয়ে, পরেই জীবনযাত্রা অতিবাহিত করতে হত। তারজন্য ছিল অপার ফসলের ভান্ডার।

শুরু হল বৈদেশিক আক্রমণ, লুঠ হল, ধ্বংস হল অবশেষে ধূলিস্মাত হল অনেক কিছু। সেই সঙ্গে ভারতের মাটিতে রোপন হল, নীতিহীন, আদর্শহীন তেলতেলে জীবন। ধীরে ধীরে বাঁজা হতে শুরু করলো ভূমি, অন্যের উপর নির্ভরশীল হতে শিখল ভারত। শিল্প এলো, বিদেশী চাষের কৌশল এলো, জীবনযাত্রার মান বদলাতে শুরু করলো। প্রাচীন ভারতীয় খোলস ছেড়ে পুরোদস্তুর পশ্চিমী হয়ে উঠতে শুরু করলাম। কারণ আধুনিক বিশ্বের ঈশ্বর ওরাই।

ভারত বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্ জনসংখ্যার দেশ। মাথা ও বাহুতে শত্রুদের কালো ছায়া। ফলে প্রতিরক্ষাখাতে বিপুল খরচ বহন করতে হয়। এ ছাড়া রেল, পরিবহণসহ একাধিক ক্ষেত্রেই তেলের উপর নির্ভরশীল। ফলে যা আমদানি হয়, তার অধিকাংশ চলে যায় রফতানিতে। তাহলে উপায়? উপায় একটাই আপাতত রক্তক্ষরণ বন্ধ করা।

ভূমিকা ছেড়ে এবার আসা যাক আসল কাহিনীতে। ৪০ টাকা লিটার ডিজেল। এটা কি এখনকার বাজারে সম্ভব? আপনি হয়তো বলবেন, পাগলের প্রলাপ। কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলে জানা যাবে পাগলের প্রলাপ নয়। কারণ, আমদানি করা তেলের বিকল্প হিসেবে ইতিমধ্যেই জায়গা করে নিচ্ছে, আমাদের প্রকৃতি থেকে গজিয়ে ওঠা কিছু অবহেলিত গাছ-গাছড়া। যেমন রেড়ি, ভেন্ডি, এই সব থেকেই তৈরি হচ্ছে বায়ো ডিজেল। যা খনিজ তেলের থেকেও শক্তিশালী অথচ দূষণ অত্যন্ত কম।

প্রায় বছর কুড়ি আগেকার কথা, কিছু ছোট ও মাঝারি উদ্যোপতি শুরু করেছিল, বায়ো ডিজেলের ব্যবসা। ভারতের বহু জায়গায় অকৃষিযোগ্য জমি রয়েছে, সেই সব এলাকার মালিকদের সঙ্গে কথা বলে, রেডি, ভেন্ডি চাষ করানো হত।

তারপর পর্যাপ্ত মূল্য দিয়ে তুলে নিয়ে বানানো হত বায়ো ডিজেল। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই মার্কিটিং করা হত। এমনকী কলকাতা ও মফফসে বেশ কিছু রুটের বাসও চলতো এই বায়ো ডিজেলকে নির্ভর করেই। তখন পেট্রোল পাম্পে ডিজেলের যা দাম ছিল, বায়ো ডিজেল মিলত তার থেকে ৫ টাকা কমে।

কিন্তু আচমকাই চোরাগোপ্তা পথে আঘাত শুরু হল, উঠে যেতে লাগল, বায়ো ডিজেল প্লান্ট। স্বাভাবিক, বিদেশ থেকে আমদানি করা তেলের বাজারে ভাগ বসালে, মরতেতো হবেই। ঠিক যেমন, আধুনিক চিকিত্সা বিজ্ঞানের একটি লবি, বারবার প্রমাণ করার চেষ্টা করে, ভারতীয় প্রাচীন চিকিত্সা শাস্ত্র সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক। তার কোনও প্রামাণ্য তথ্য নেই।

২০০৬ সালে কেন্দ্রীয় পেট্রোলিয়াম ও প্রকৃতিক গ্যাস মন্ত্রক একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, ভারতের যতগুলি বাল্ক ক্রেতা যেমন রেল, স্টেট রোড ট্রান্সপোর্ট রয়েছে তাদের ব্লেন্ডেড ডিজেল দিতে হবে। অর্থাত ডিলেজের সঙ্গে বায়ো ডিজেল ব্লেন্ড করে দিতে হবে। এতে খরচও যেমন কমবে, তেমনই দূষণও কম হবে। কিন্তু কোনও অদৃশ্য শক্তির কাছে হার স্বাকীর করে এই সিদ্ধান্ত।

২০১৫ সালে, এই সিদ্ধান্তকে কার্যকর করে কেন্দ্রীয় পেট্রোলিয়াম ও প্রকৃতিক গ্যাস মন্ত্রক। ফলে বায়ো ডিজেল বাজারে নতুন করে প্রাণ পায়। ২০১৭ সালে সরকার সমস্ত ক্রেতার ক্ষেত্রেই বায়ো ডিজেলের রাস্তা খুলে দেয়।

মজার ব্যাপার, আমাদানিকৃত কাচা তেল, রিফাইনের পর ডিজেলের যা দাম হয়, তার থেকে অনেক কম দামে মেলে এই বায়ো ডিজেল। মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ, বিহার, ঝাড়খণ্ড এবং রাজস্থান, পাঞ্জাবের একটা অংশ রয়েছে যা খাদ্য শস্য উত্পাদনে অযোগ্য, সেই সব এলাকায় রেডি, ভেন্ডির চাষ করে চাষিরা বায়োডিজেলের প্রাথমিক উপাদান তৈরি করছে। বাঁজা জমি থেকেও আয় করছে তারা। পশ্চিমবঙ্গেও বেশ কিছু ইউনিট চালু হয়েছে।

সরকারও ব্লেন্ডেড ডিজেল দিয়ে বিপুল অর্থ উপার্জন করছে। ফলে যে কর আগে আদায় হত, মূল্য একই রাখায় অন্তত ৩৫ শতাংশ কর বাড়তি মুনাফা করছে। আমাদের দেশে কাচা তেল আমদানির পর, রিফাইন করা হয়। তার মধ্যে থেকে সবথেকে বেশি ব্যবহার করা হয় ডিজেলকে, কারণ রেল ও পরিবহণ এবং কিছু উত্পাদন শিল্পে বড় জায়গা দখল করে আছে ডিজেল। আর সেই জায়গাতেই বড় ধরণের রাশ টেনেছে দেশীয় বায়ো ডিজেল।

এখন এখানে প্রশ্ন, ব্লেন্ডেড ডিজেলে যদি এতো লাভ করে থাকে সরকার, তাহলেতো দাম কমানো যেতে পারে? উত্তর হল না, এই তেলের কর এখনও জি এসটির আওতায় আসেনি, আসতে দেওয়া হয়নি। এতে যেমন কোম্পানি গুলির মুনাফা রয়েছে, তেমনই কেন্দ্র ও রাজ্যগুলিরও মুনাফা রয়েছে বিপুল। সরকার চাইছে, এই ব্লেন্ডেড তেলের পরিমাণ বাড়াতে। ফলে আমদানি কম করতে হবে এবং খরচও কম হবে।

ফলে বাজার যদি দেখা যায়, গত ৫-৬ বছরে বায়ো ডিজেল প্রোডাকশনে বহু ছোট প্লেয়ার বাজারে জন্ম নিয়েছে। তারা এই তেল রফতানি করে মুনাফা করছে সেই সঙ্গে দেশের বৈদেশিক মুদ্রাও বাড়ছে।

এখানে প্রশ্ন, আমাদের সাধারণ মানুষের কি স্বস্তি মিলবে? এর উত্তরটা অদ্ভুত, ধরা যাক, দুটি পাশাপাশি পেট্রোলপাম্প রয়েছে, একটিতে বায়ো ডিজেল বিক্রি হচ্ছে ৭৫ টাকা লিটারে। আর অন্যটিতে ব্লেন্ডেড (আমরা অনেকেই যেটি জানি না) ডিজেল ১০৫ টাকায়। কোনটি নেবো?

উত্তর আপনারা সবাই জানেন, কোনটি নেবেন, তাই আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

এই পুরো প্রতিবেদনের মূল প্রতিপাদ্য হল, আমরা নেতা নেত্রীদের যতই গালাগাল দিই না কেন, সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস তাদেরই করি।

আমাদের সমস্ত খবরের আপডেট পেতে যুক্ত হয়ে যায় টেলিগ্রাম চ্যানেলে

আমাদের চ্যানেলে যুক্ত হয়ে যান

About Orbit News

Check Also

উত্তরাখণ্ডের পঞ্চ বদ্রি: ভগবান বিষ্ণুর পবিত্র পাঁচ ধাম

উত্তরাখণ্ডের হিমালয়ের কোল জুড়ে ছড়িয়ে থাকা পাঁচটি পবিত্র বদ্রি মন্দির – বদ্রীনাথ, যোগধ্যন বদ্রি, ভবিষ্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!