বিষ্ণুপুরের মল্লরাজবংশ: ইতিহাস, ঐতিহ্য ও স্থাপত্য
পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার অন্তর্গত বিষ্ণুপুর শুধু টেরাকোটা মন্দিরের শহর নয়, এটি একসময়ের এক সমৃদ্ধ রাজবংশের রাজধানীও ছিল। এই শহরের গৌরবময় ইতিহাস রচনা করেছেন মল্লরাজারা, যারা প্রায় ১০০০ বছর ধরে (৭০০-১৯৮০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত) শাসন করেছেন। তাঁদের রাজত্বে বিষ্ণুপুর হয়ে উঠেছিল শিল্প, সংস্কৃতি, সংগীত এবং স্থাপত্যশিল্পের এক অনন্য কেন্দ্র।
মল্লরাজাদের উত্থান ও রাজবংশের সূত্রপাত
মল্লরাজাদের বংশপরম্পরার সূচনা সম্পর্কে ইতিহাসে ভিন্ন ভিন্ন মতামত পাওয়া যায়।
- বলা হয়, রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা অদ্য মল্ল (প্রথম রাজা) ৭০০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ বিষ্ণুপুর অঞ্চলে তাঁর শাসন শুরু করেন।
- রাজ্যের নাম “মল্লভূম” হয় মূলত তাঁদের যোদ্ধা স্বভাবের কারণে, কারণ “মল্ল” শব্দের অর্থ যোদ্ধা বা কুস্তিগীর।
- ১০০০-১১০০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ এই রাজবংশ শক্তিশালী হয় এবং সেন রাজাদের অধীনে থাকলেও পরে স্বতন্ত্রভাবে রাজত্ব করতে শুরু করে।
মল্লরাজাদের স্বর্ণযুগ (১৬-১৭ শতক)
বিষ্ণুপুরের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় শুরু হয় বীর হাম্বীর (১৫৮৬-১৬২১ খ্রিস্টাব্দ)-এর শাসনকালে।
বীর হাম্বীর ও মল্লরাজাদের শক্তিশালী সাম্রাজ্য
- বীর হাম্বীর ছিলেন একজন সুপরিচিত তান্ত্রিক ও বৈষ্ণব ধর্মানুসারী।
- তাঁর শাসনামলে বিষ্ণুপুরে বৈষ্ণব ধর্মের প্রসার ঘটে এবং টেরাকোটা স্থাপত্যের বিকাশ হয়।
- তিনি প্রথমে শাক্ত ধর্মাবলম্বী ছিলেন, কিন্তু পরে শ্রী চৈতন্যদেবের অনুসারী হন এবং বিষ্ণুপুরকে এক বৈষ্ণব তীর্থে পরিণত করেন।
- তাঁর সময় মোগলদের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়, তবে তিনি কৌশলে রাজ্যকে রক্ষা করেন।
রঘুনাথ সিংহ (১৬২১-১৬৬০ খ্রিস্টাব্দ) ও টেরাকোটা স্থাপত্যের বিকাশ
- তাঁর আমলে বিষ্ণুপুরের বিখ্যাত রাসমঞ্চ, শ্যামরায় মন্দির, জোড়া মন্দির, মদনমোহন মন্দির তৈরি হয়।
- তিনি সঙ্গীত ও চিত্রকলাকে পৃষ্ঠপোষকতা দেন এবং বিষ্ণুপুর ঘরানার শাস্ত্রীয় সংগীতের প্রচলন করেন।

বিষ্ণুপুরের রাজনৈতিক শক্তির হ্রাস (১৮-১৯ শতক)
- ১৭শ শতকের শেষের দিকে মল্লরাজাদের শক্তি ধীরে ধীরে কমতে থাকে।
- মারাঠা আক্রমণের ফলে বিষ্ণুপুর রাজ্যের অর্থনীতি দুর্বল হয়ে পড়ে।
- ১৭৬৫ সালে মোগল সম্রাট শাহ আলম বাংলার দেওয়ানি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে দেওয়ার পর, মল্লরাজাদের রাজনৈতিক শক্তি প্রায় শেষ হয়ে যায়।
মল্লরাজাদের স্থাপত্য ও সংস্কৃতি
মল্লরাজারা শুধু রাজ্য পরিচালনায় দক্ষ ছিলেন না, তাঁরা শিল্প, সংস্কৃতি ও স্থাপত্যের অন্যতম প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।
১. টেরাকোটা মন্দির স্থাপত্য
বিষ্ণুপুরের মল্লরাজারা বাংলার মন্দির স্থাপত্যে নতুন মাত্রা যোগ করেন। এদের তৈরি মন্দিরগুলোতে
- পোড়ামাটির (টেরাকোটা) অসাধারণ কারুকাজ
- বৈষ্ণব ধর্মের কাহিনি খোদাই করা
- ইট ও টেরাকোটার সম্মিলনে স্থাপত্যশৈলীর এক অনন্য দৃষ্টান্ত দেখা যায়।
বিখ্যাত মন্দিরগুলো হলো—
- রাসমঞ্চ (১৬০০ খ্রিস্টাব্দ): এখানে রাজারা দুর্গাপূজা ও রাসউৎসব পালন করতেন।
- শ্যামরায় মন্দির (১৬৪৩ খ্রিস্টাব্দ): পাঁচচূড়া বিশিষ্ট অপূর্ব স্থাপত্যের মন্দির।
- মদনমোহন মন্দির (১৬৯৪ খ্রিস্টাব্দ): এটি বিষ্ণুপুরের অন্যতম প্রধান বৈষ্ণব মন্দির।
২. বিষ্ণুপুর ঘরানার সংগীত
- মল্লরাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় বিষ্ণুপুর ঘরানার ধ্রুপদ সংগীত বিকশিত হয়।
- এই ঘরানার অন্যতম বিশিষ্ট শিল্পী ছিলেন জাদুবতী দেবী ও গোপালকৃষ্ণ।
৩. মল্লরাজাদের ধাতব শিল্প ও টেরাকোটা শিল্প
- বিষ্ণুপুরের টেরাকোটা ঘোড়া ও পোড়ামাটির মূর্তি আজও বিশ্ববিখ্যাত।
- ধাতব শিল্পেও তাঁরা দক্ষ ছিলেন, যা বিষ্ণুপুরের ঐতিহ্য হিসেবে টিকে আছে।
রাজবংশের পতন ও বর্তমান অবস্থা
- ১৯৫০ সালে রাজপ্রথা বিলুপ্ত হলে মল্লরাজাদের আনুষ্ঠানিক শাসনের অবসান ঘটে।
- তবে আজও তাঁদের বংশধরেরা স্থানীয়ভাবে সম্মানিত হন এবং রাজপরিবারের কিছু অংশ ঐতিহ্য রক্ষায় নিয়োজিত রয়েছেন।
- মল্লরাজাদের তৈরি স্থাপত্য ও সংস্কৃতি আজও বিষ্ণুপুরকে বাংলার অন্যতম ঐতিহ্যবাহী পর্যটন কেন্দ্র করে রেখেছে।
উপসংহার
মল্লরাজারা শুধুমাত্র এক প্রাচীন রাজবংশের প্রতিভূ ছিলেন না, তাঁরা বাংলার স্থাপত্য, সংগীত ও সংস্কৃতির অন্যতম শ্রেষ্ঠ পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তাঁদের আমলে গড়ে ওঠা বিষ্ণুপুর আজও ইতিহাসপ্রেমীদের জন্য এক অনন্য গন্তব্য।
🙏 আপনি যদি ইতিহাস ও স্থাপত্য ভালোবাসেন, তাহলে বিষ্ণুপুরের মল্লরাজাদের তৈরি মন্দির, সংগীত ও শিল্পকর্মের স্বাদ নিতে অবশ্যই একবার সেখানে ঘুরে আসতে পারেন!
