পূর্ণেন্দু ব্যানার্জি- আপনারা অনেকেই হয়তো আন্দামান বেড়াতে গিয়েছে, কিন্তু জানতেন কি আন্দামান সেলুলার জেলের এমন এক ইতিহাস? তাহলে শুরু করা যাক বিশ্বের ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের তকমা পাওয়া সেলুলার জেলের সেই অজানা কাহানি।
ভারতের কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল আন্দামান নিকোবর দ্বীপ পুঞ্জের মধ্যে রয়েছে মোট ৫৭২টি দ্বীপ। তারই একটি দ্বীপ দক্ষিণ আন্দামান দ্বীপ এখানেই রয়েছে বিখ্যাত সেসুলার জেল।
এই দ্বীপে এখনও দেখা যায়, দু হাজার বছর ধরে থাকা স্থানীয় ভূমিপুত্রদের। যাদের জাড়োয়া বলে আমরা জানি। অষ্টাদশ শতাব্দীর মাধামাঝি সময়ে এই দ্বীপপুঞ্জ ইউরোপীয়দের দখলে আসে। কয়েক বছর বাদে এখানে ব্রিটিশরা একটি নৌসেনা ছাউনি বা নেভাল বেস ক্যাম্প তৈরি করে , এবং ছাতাম দ্বীপে অপরাধীদের শাস্তি দেওয়ার জন্য জেল তৈরি করা হয়। পরে সেই কারাগার স্থানান্তর করা হয় ভাইপার দ্বীপে।
প্রাথমিক ভাবে কারাগারের পরিকল্পনা ছিল অস্থায়ী। কিন্তু ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের পর ব্রিটিশরা পাকাপাকি কারাগার তৈরির পরিকল্পনা করে। সেই বছরই ডিসেম্বর মাসে দ্বীপ ঘুরে একটি রিপোর্ট পেশ করা হয়। এক মাসের মধ্যে রিপোর্ট যায় লন্ডনে। ১৮৫৮ সালের ১০ মার্চ প্রথম ২০০ জন অপরাধীকে এখানে এনে রাখা হয়।
ব্রিটিশরা ভেবেছিল, প্রথম দিকের স্বাধীনতার বিপ্লবীদের এমন একটা কারাগারে এনে রাখলে হয়তো স্বাধীনতার আওয়াজ চাপা পড়ে যাবে। কিন্তু তা হয়নি। অঞ্চল ভেদে আগুনটা জ্বলছিলই। ওয়াহাবি আন্দোলন, মণিপুরি বিদ্রোহ, বার্মার থারাওড়া থেকে ব্যাপক বিদ্রোহের আগুন জ্বলতে শুরু করে ইংরেজদের বিরুদ্ধে। তাদের প্রত্যেককেই পাঠানো হত আন্দামানে। প্রথম দিকে এই দ্বীপে খোলা অবস্থাতেই রাখা হত অপরাধীদের।
ধীরে ধীরে যখন অপরাধীদের সংখ্যা বাড়তে থাকলো, তখন অন্য মাথা ব্যাথা শুরু হল ইংরেজদের। নজরদারি চালানো কঠিন হয়ে পড়ছিল। তখন ব্রিটিশ আধিকারিক স্যার চার্লস জে ল্যাল এবং এ এস লেথব্রিজ ১৮৯০ সালে পোর্ট ব্লেয়ারে যান। এবং একটি পাকাপোক্ত কারাগার নির্মানের পরামর্শ দেন পোর্ট ব্লেয়ারে।
১৮৯৩ সালে কাজ শুরু হল পাকাপোক্ত কারাগার নির্মানের ১৯০৫-০৬ সালে কারাগার নির্মাণের কাজ শেষে হয়। আন্দামানে যত অপরাধী বন্দি ছিল, তাদের দিয়ে এই কারাগার নির্মানের কাজ করানো হয়। প্রত্যেক অপরাধী ছিল শ্রমিক। এমন একটি ঐতিহাসিক নির্মাণের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ভারী বুটের আঘাত, চাবুকের মার, অর্ধাহার, চূড়ান্ত অত্যাচারের কালো ইতিহাস।
সেলুলার জেল প্রকাণ্ড তিনতলার স্থাপত্য। মোট সাতটি শাখা রয়েছে, এবং প্রত্যেকটির দৈর্ঘ্য অসমান। কারাগারের স্থাপত্যটা প্রথম থেকে পরিকল্পনা হয়েছিল সেপারেট সিস্টেম বা বিচ্ছিন্ন ব্যবস্থাকে মাথায় রেখে। অর্থাত একজন কয়েদির সঙ্গে অন্য কয়েদির কোনও যোগ থাকবে না। এই শাখা হোক বা অন্য শাখা। এমনকী পাশের রুমে কোন কয়েদি আছে সেটাও জানতে পারবে না কোনও কয়েদি।
আরও পড়ুন- কাশ্মীর ও হিমাচলের দুটি সফর পরিকল্পনা
আরও পড়ুন- গাড়োয়াল সফরে কী দেখবেন, কেন দেখবেন?
স্থাপত্য এমন ভাবে নির্মাণ করা হয়েছিল, একজন গার্ড একটি শাখার সমস্ত কয়েদির উপর নজর রাখতে পারবে, কিন্তু কোনও কয়েদি গার্ডকে দেখতে পারে না। ইংরেজ শাসনকালে সেলুলারর জেলা মূলত সেই সব কয়েদিদের পাঠানো হত, যারা বিপ্লবী ছিল এবং রাজনৈতিক বন্দী।
এখানে যাঁরা কয়েদি ও লেবার হিসেবে কাজ করেছিল, তারা প্রত্যেকেই ভারতীয় ভূখণ্ডের নাগরিক ছিলেন। কারাগার নির্মাণের সমস্ত ইমারতী দ্রব্য আনা হয়েছিল বার্মা থেকে। কারাগান নির্মাণ করতে লেগেছিল ২০ হাজার কিউবিক ফিট পাথর এবং ৩০ লক্ষ ইট। সেলুলার জেলে নামকরা বিপ্লবীরা বন্দি ছিলেন। তাঁদেরই মূলত দীর্ঘমেয়াদী সাজা হত। কিন্তু বিদ্রোহ বলে কথা। অধিকার লড়াই যে খানে হোক সে মাঠ, জল, জঙ্গল বা কারাগার সর্বত্র সমানই থাকে।
১৯৩২ সাল থেকে ইংরেজদের অত্যাচার বাড়তে থাকল কারাগারের মধ্যেও, শুরু হল গণ অনশন। দফায় দফায় গণ অনশন চলতে থাকে ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত। ১৯৩৭ সালে টানা ৪৫ দিন অনশন শুরু করেন রাজনৈতিক বন্দী থেকে বিপ্লবীরা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও মহাত্মা গান্ধীর আবেদনে সেই অনশন আন্দোলন ছাড়েন বিপ্লবীরা। পরে তাদের বেশ কয়েকজনকে ভারতের বিভিন্ন জেলে স্থানান্তর করা হয়।
বেড়াতে যাওয়ার জন্য ভালো গ্রুপ পাচ্ছেন না? জুড়ে যান আমাদের সঙ্গে ক্লিক করুন এখানে
দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ শুরু হলে আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ জাপানের দখলে চলে যায় (১৯৪২-৪৫)। ১৯৪৩ সালে ২৯ ডিসেম্বর নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস যান সেলুলার জেলে প্রাদেশিক ভারত সরকারের প্রধান হিসেবে। তিনি এই পোর্ট ব্লেয়ার সেলুলার জেলে বসেই বলেছিলেন, এটি ভারতের বাস্তিল। প্রথমে সেলুলার জেলে মোট ৭টি শাখা ছিল। ১৯৪১ সালের ভূমিকম্পে চারটি শাখা নষ্ট হয়। তিনটি অবশিষ্ঠ ছিল।
১৯৪৭ সালে ক্ষমতা হস্তান্তরের পর (স্বাধীনতার পর) এই জেলে কাটিয়েছিলেন এমন বহু বিপ্লবী, স্বাধীনতা সংগ্রামী প্রস্তাব রেখেছিলেন, এই কারাগারকে স্বাধীনতা সংগ্রামে জাতীয় স্মারক হিসেবে রক্ষা করা হোক। ১৯৭৯ সালে ১১ ফেব্রুয়ারি এই কারাগারকে জাতীয় স্মারক হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
সারা বিশ্বে বহু দ্বীপে অপরাধিদের নিয়ে কলোনি গড়ে তুলেছিল ব্রিটিশরা। গড়ে তুলেছিল কারাগার, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা তারই নজির। কিন্তু আন্দামানের সেলুলার জেলের সমতূল সারা বিশ্বে আর একটিও নেই। ২০১৪ সালে এটি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের তালিকায় আসে।
আন্দামান বেড়ানোর ট্যুর পরিকল্পনা
১। কলকাতা থেকে বিমানে পোর্টব্লেয়ার। সকাল সকাল পৌঁছলে বিকেলেই দেখে নিন সেলুলার জেল এবং সন্ধেবেলা লাইট অ্যন্ড সাউন্ড।
২। সারা দিন প্রোগ্রাম রাখুন, রস, ভাইপার এবং নর্থ-বে আইল্যান্ড।
৩। জাড়োয়া রিসার্ভ লাইনের মধ্যে দিয়ে সফর, লাইমস্টোন কেভ, মাড ভলক্যানো দেখে পোর্টব্লেয়ার ফিরুন।
৪। পোর্টব্লেয়ার থেকে সকালে হ্যাভলক যাত্রা। কালাপাথর, বিজয়নগর বিচ, বিকেলে রাধানগর বিচের সূর্যাস্তের ছবি ও সেল্ফি তুলতে ভুলবেন না।
৫। এলিফ্যান্টা বিচে সমুদ্র স্নান করে ফেরা। দুপুরে হ্যাভলক থেকে নীল দ্বীপের উদ্দেশে রওনা। নীলের লক্ষ্মণপুর ১ বিচে সূর্যাস্তের সাক্ষী থাকুন।
৬। লক্ষ্মণপুর-২ বিচে ন্যাচারাল কোরাল ব্রিজ, সীতাপুর বিচ, ভরতপুর বিচে স্নান সেরে নিতে পারেন। বিকেলে নীল থেকে পোর্টব্লেয়ার ফেরা।
৭। এদিন পোর্ট ব্লেয়ারের আশে পাশে সারাদিনের সাইট সিন দেখে নিন। চাথাম সমিল, মাউন্ট হেরিয়েট, সামুদ্রিকা, কারবাইনস কোপ বিচ, অ্যন্থ্রোপোলজিক্যাল মিউজিয়াম, ফিসারিজ মিউজিয়াম।
৮। বিমানে কলকাতায় ফেরা।
**চাইলে আরও বেশি দিন থাকতে পারেন, সেক্ষেত্রে আন্দামানের আরও বেশ কিছু হিডেন জেম রয়েছে, সফরের তালিকায় সেগুলো জুড়ে নিতে পারেন। আগামী দিনে সেই সফর পরিকল্পনাও এই গ্রুপে শেয়ার করা হবে।
নোটবুক-![🤓]()
হ্যাভলক, নীল, লিটল আন্দামানে যাওয়া আসার জাহাজের টিকিট এক মাস আগেই দেওয়া হয়, তাই কারও উপর নির্ভরশীল হওয়ার প্রয়োজন নেই।
সেলুলার জেলা লাইট অ্যান্ড সাউন্ডের টিকিট সিজিনে প্রচুর ডিমান্ড থাকে, তাই সেখানে দালাল ছাড়া টিকিট পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।
আন্দামানে পানীয় জল কিনে খাওয়া উচিত।
কিং কোকোনাট অবশ্যই খান।
জাহাজে ওঠার সময় ভোটার কার্ড সঙ্গে রাখা জরুরি।
জাড়োয়াদের ছবি তোলা নিষিদ্ধ। ধরা পড়লে, অপমানিত, ক্যামেরা বাজেয়াপ্ত, জরিমানাও হতে পারে।
মোবাইল নেটওয়ার্কের হিসেব জানতে হলে বি এস এন এল সেরা।
পোর্টব্লেয়ার, হ্যাভলক, নীল ছাড়া বাকি দ্বীপে এ টি এম পরিষেবা প্রায় নেই বললেই চলে।
হ্যাভলক, নীল, লিটল আন্দামানে বাইক, স্কুটি, সাইকেল ভাড়া পাওয়া যায়, পারলে নিজের মতো ঘুরে নিতে পারেন।
সেলুলার জেল ৭ দিন খোলা। কিন্তু পোর্টব্লেয়ারে সামুদ্রিক, ফিসারিজ এবং অ্যান্থ্রোপোলজিক্যাল মিউজিয়াম সোমবার ও সরকারি ছুটি দিনে বন্ধ।
বিশেষ সাহায্যের জন্য হোয়াটস অ্যাপ করুন। 9073503958 এএই নম্বরে