হাওড়া: ইতিহাসে মোড়া এক প্রাচীন জনপদ
পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী জেলা হাওড়া। ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখা যায়, প্রাচীন সূহ্ম দেশের অংশ ছিল এই অঞ্চল। পরবর্তীতে এটি ভুরশুট রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। মুর্শিদকুলি খাঁর আমলে ভূমিরাজস্ব নীতির পরিবর্তনের ফলে, ১৭২২ সালে হাওড়া বর্ধমান ও আমিনপুর জমিদারির অন্তর্ভুক্ত হয়।
১৭৬০ সালের ১১ অক্টোবর, নবাব মিরকাশিমের চুক্তি অনুযায়ী হাওড়া জেলা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। তবে ১৭৮৭ সালে হুগলি জেলা গঠিত হলে, হাওড়া তার জেলা মর্যাদা হারিয়ে হুগলির অংশে পরিণত হয়। শেষমেশ ১৮৪৩ সালে হুগলি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে হাওড়া পুনরায় স্বতন্ত্র জেলা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
এই জেলার অন্তর্গত বাগনান এক প্রাচীন জনপদ, যার ইতিহাস লোককথা ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনে ভরপুর। বহু গবেষক মনে করেন, বাগনানের নামকরণ হয়েছে এখানকার বৃন্দাবনতলার মাঠে অবস্থিত বাগেশ্বরী দেবীর নাম অনুসারে।
বাগনানের কৃতিসন্তান পুরাতত্ত্ববিদ ও লোকসংস্কৃতি গবেষক তারাপদ সাঁতরা বহু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিষ্কার করেছিলেন এই এলাকায়—যার মধ্যে রয়েছে সপ্তম থেকে ত্রয়োদশ শতকে নির্মিত পাথরের মূর্তি ও স্তম্ভ। অতীতে বাগনান ছিল নিজস্ব লোকশিল্পের জন্য বিখ্যাত, বিশেষত কালিকাপাতাড়ি লোকনৃত্যের জন্য। শিবরাত্রির রাতে মহিলাদের জাগিয়ে রাখতে পৌরাণিক কাহিনি, গান ও নৃত্যের সংমিশ্রণে এই নৃত্যশৈলী সৃষ্টি হয়েছিল।
কিন্তু আজকের বাগনান, সবচেয়ে বেশি পরিচিত তার ঐতিহাসিক খালোড় কালীমন্দিরের জন্য। বাগনান স্টেশন থেকে আড়াই কিলোমিটার দূরে অবস্থিত খালোড় গ্রাম, যার ইতিহাস পাওয়া যায় ‘আইন-ই-আকবরী’-তেও। এখানেই সাড়ে চারশো বছর ধরে বিরাজ করছেন এক জাগ্রত দক্ষিণাকালী, যাঁর প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছে রাজ্যের গণ্ডি পেরিয়ে দেশের নানা প্রান্তে।
এই কালী মা শুধু আস্থা ও ভক্তির প্রতীক নন—তিনি বাগনানের অভিভাবিকা। তাঁর আশীর্বাদ ছাড়া এখানে কোনও শুভকাজ শুরু হয় না। বিয়ের আগে, নির্বাচন প্রচারের আগে এমনকি ব্যবসায়িক উদ্যোগের সূচনায়ও মায়ের পূজো দেওয়া হয়। বহু নেতা, দম্পতি ও ভক্তরা আজও এই নিয়ম অনুসরণ করেন।
মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে জনশ্রুতি রয়েছে বর্ধমানের মহারাজা কন্দর্পনারায়ণের নাম। তবে ইতিহাসবিদরা এ বিষয়ে দ্বিধান্বিত। বর্ধমান রাজবংশের প্রামাণ্য তালিকায় কন্দর্পনারায়ণের নাম অনুপস্থিত এবং এই বংশের ইতিহাসও সাড়ে চারশো বছরের নয়। ফলে অনেকেই মনে করেন, এই কন্দর্পনারায়ণ ছিলেন বারো ভুঁইয়াদের অন্যতম—চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যের নবম রাজা, যাঁর রাজ্য বিস্তৃত ছিল বর্তমান বাংলাদেশের বরিশাল, বিক্রমপুর ও মুন্সিগঞ্জ অঞ্চলে।
সেই সময় মোগল শাসনের মধ্যেও হিন্দু ধর্ম ও সংস্কৃতির পুনর্জাগরণে বহু রাজা-মহারাজা বাংলার নানা প্রান্তে মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। উদাহরণস্বরূপ, নাটোরের রানি ভবানী যেমন কাশী ও জিয়াগঞ্জে মন্দির নির্মাণ করেছিলেন, তেমনই কন্দর্পনারায়ণও বাগনানে এই জাগ্রত কালীমন্দির প্রতিষ্ঠা করে গেছেন।
এই ইতিহাস শুধু ধর্মীয় আস্থা নয়, বরং বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে উঠেছে। খালোড় কালীবাড়ি মন্দিরের সামনেই, প্রতিবছর ঝাপান উৎসব পালন হয়ে আসে। স্থানীয় একটা অংশের মানুষ ঝাপান উৎসবে প্রত্যক্ষ যোগ দেন। তিরিশ ফুট উচ্চতা বাঁশের একটি খাঁচার উপর থেকে তাঁরা ঝাঁপ দিয়ে পড়েন, লোহার খাঁজযুক্ত শলাকার মধ্যে। নীচে কিছু মানুষ সেই শলাকা ধরে দাঁড়িয়ে থাকেন।


খালোড় কালীবাড়িতে কীভাবে যাবেন?
- রেলপথে: হাওড়া স্টেশন থেকে বাগনান লোকাল ট্রেনে বাগনান স্টেশনে নেমে, সেখান থেকে অটো বা টোটো ধরে খালোড় কালীবাড়ি পৌঁছানো যায়।
- সড়কপথে: হাওড়া থেকে জাতীয় সড়ক ধরে গাড়িতে প্রায় ৬০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে এখানে পৌঁছানো যায়।
উপসংহার
খালোড় কালীবাড়ি শুধু ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেই নয়, বাংলার লোকসংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের এক অন্যতম প্রতীক। কালীপূজা ও ঝাপান উৎসবের সময় মন্দির প্রাঙ্গণ এক অনন্য পরিবেশ সৃষ্টি করে, যা একবার প্রত্যক্ষ করা প্রতিটি ভক্ত ও দর্শনার্থীর জন্য এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা।
