অর্বিট নিউজ ডেস্ক- অফিস বা ব্যাবসার কাজের চাপ থেকে কিছুটা ছুটি। বন্ধু বান্ধব মিলে পরিকল্পনা, লং ড্রাইভ মোটরবাইকে। প্রকৃতির টানে ছুটে বেড়ানো। সফরের পথে নানা ঘটনা, অনুকুল, প্রতিকূল পরিবেশের মুখোমুখি হওয়া, ঘাত প্রতিঘাত সামলে আবার এগিয়ে যাওয়া। সেই সঙ্গে পুরো ছবি তুলে নিজের অনুভব লাখ লাখ মানুষের সঙ্গে শেয়ার করে নেওয়া। গত কয়েক বছরে বিশ্বজুড়ে এক নতুন বিপ্লবের সূচনা করেছে সোশাল মিডিয়া। নিজেদের ভাবনা চিন্তা, বিশ্বকে অন্যভাবে দেখার সুযোগ করে দিয়েছে। আর সেই নেশাতেই ধীরে ধীরে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বর্তমান যুব সমাজ।
গত কয়েক বছরে মোটরবাইকে লম্বা সফর একটি ট্রেন্ড ধরা পড়েছে। সোশাল মিডিয়ায় তৈরি হয়েছে অজস্র কমিউনিটি। কোথায় যাওয়ার জন্য কোন, গ্যাজেট দরকার, কোন গাড়ি ভালো মন্দ, নানা এক্সপার্টদের নানা মতামত। সেই মতামতের ওপর ভিত্তি করেই সিদ্ধান্ত নেওয়া। তবু যে জায়গায় ফাঁক থেকে যাচ্ছে, সে দিকে নজর দিচ্ছে না একদল ভ্রমণপ্রেমিক যুবক-যুবতী। লাইক কমেন্ট, শেয়ারের খেলায় বুঁদ হয়ে যাচ্ছে।
অতি সম্প্রতি যে ঘটনাটি ঘটেছে, বহরমপুরের সব্যসাচীর চ্যাটার্জির ক্ষেত্রে। বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে ষষ্ঠীর দিন বেরিয়েছিল হিমাচল। গত মঙ্গলবার বন্ধুদের সঙ্গে ফেরার পথে পথদুর্ঘটনায় প্রাণ হারান। তাঁর সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট থেকে পাওয়া বেশ কিছু ছবি থেকে আন্দাজ করা যায়, লম্বা সফরের জন্য যা সাবধানতা, সতচেতনতা নেওয়া তা সে নিতই। বহু যুবকই তা নিয়ে থাকে।
লম্বা সফরে যাওয়ার আগে, নিজেদের গাড়িকে পুরো দমে ঢেলে মেরামতির কাজ করানো, উচ্চমানের হেলমেট ব্যবহার, শরীরের নানা অঙ্গ প্রত্যঙ্গের গার্ড। সব কিছুই খামতি নেই কিছুতে, অন্তত গাড়ির ক্ষেত্রে। তবু বিপদটা ঘটছে। একাধিক অভিজ্ঞ মোটরবাইক আরোহীদের মত, দুর্ঘটনা দুর্ঘটনা, একে কখনও এড়ানো যায়, কখনও যায় না। কপালে থাকলে কিছু কিছুই করার থাকে না।
আরও পড়ুন- নৃসিংহপুরের রাজবাড়ি কেন অভিশপ্ত? কী অঘটন ঘটে ?
ভিন্ন মত আবার অভিজ্ঞ মোটরবাইক আরোহী অভিরূপ মজুমদারের। তিনি বলেন, বিপদ বাড়িতে থাকলেও আসতে পারে। আবার কপালে দুর্ঘটনা থাকলে ঘটবেই, এটা ভেবে পথ চলা কোনও বুদ্ধিমানের মতো কাজ নয়। আমাদের ছোটবেলায় বাবা মায়েরা শাসন করে কারণ, তারা যে ভুলটা করেছে, আমরা যাতে সেটা না করি। অর্থাত্ অভিজ্ঞতা একটা বিষয়। অনেকে প্যাশনের সঙ্গে এক দিনে ৫০০ কিমি রান করছে, সকাল ছটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত গাড়ি টেনে দিচ্ছে। ভুলটা এখানেই করে। আর দলব্দ্ধ ভাবে গেলে অবশ্যই নিজেদের মধ্যে একটা আন্ডারস্ট্যান্ডিং করে নেওয়া উচিত। নয়তো কেউ জোরে গাড়ি চালাচ্ছে, আবার কেউ সাবধানে ধীরে চালাচ্ছে, সেখানে সমস্যা হয়।
এতো গেল অভিজ্ঞ মোটরবাইক আরোহীদের কথা, চিকিত্সকরা দেখছেন, অন্য দিক। ডাঃ সুমন্ত পালের মতে, কম বয়সে ভালো গাড়ি নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে লং ড্রাইভে যেতে ভালোই লাগে। এর একটা আলাদা মজা আছে, নেশাও আছে। এটাকে আটকানো যাবে না। কিন্তু অবশ্যই সচেতন হওয়া যায়, যদি আসল দিকটা জানা যায়, সেই মতো আগাম ব্যবস্থা নেওয়া।
কী সেই দিক?
ডাঃ পালের মতে, ধরে নিচ্ছি, একশো শতাংশ মোটরবাইক আরোহী যাঁরা লং ড্রাইভে যান, তাঁরা প্রত্যেকে তাঁরা তাঁদের গাড়ি, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা পরিপাটি করেই যান। কিন্তু নিশ্চিত করে বলতে পারি ৯৯ শতাংশ আরোহী নিজেদের শরীরের প্রতি সচেতন নন। গাড়ি নিয়ে যতটা প্যাশন থাকে শরীর নিয়ে নয়।
ঠিক কী রকম সেটা?
প্রথম অধিকাংশ যাঁরা মোটরবাইকে লং ড্রাইভে যান, তাঁরা ইয়ং, গড় বয়স ২৮ থেকে ৪০ এর মধ্যে। এদের অধিকাংশ কম্পিউটার বেসড কাজ করে, কেউ আইটি বিভাগে, কেই ইঞ্জিনিয়ার, কেউবা হয়তো ব্যবসায়ী। মোটারবাইক নিয়ে বেড়াতে যাওয়া নেশা। অত্যধিক বসে কাজ করা ব্যক্তিদের ঘাড়ে একটা সমস্যা ধীরে ধীরে দানা বাঁধে। সেটা সহজ ভাবে বললে স্পন্ডেলাইটিস।
মোটাইবাইক চালানোর সময় অবশ্যই ভালো হেলমেট ব্যাবহার করা উচিত। আর ভালো হেলমেটগুলি বেশ ভারীও হয়। ফলে টানা অনেক্ষণ পরে থাকলে ঘাড়ের উপর একটা চাপ সৃষ্টি করে।
এতে কী হতে পারে?
এর থেকে যা হতে পারে, তার ফল একমাত্র প্রাণঘাতী। যেমন ঘরা যাক, একটি ইয়ং ছেলে এক্সপ্রেসওয়েতে গা়ড়ি চালাচ্ছে। তার শরীরে কোনওদিন সে কোনও সমস্যা অনুভব করেনি। তার গাড়ি চলছে ৭০ থেকে ৮০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টায়। এই চলার পথে আচমকা কয়েক সেকেন্ডের জন্য ব্ল্যাক আউট। দুর্ঘটনা ঘটলো, কিন্তু তার কোনও ইঙ্গিত মিলল না। আমরা এমন বহু পেশেন্ট পাই রাস্তায় দাঁড়িয়ে একজনের সঙ্গে কথা বলতে বলতে আচমকা ব্ল্যাক আউট হচ্ছে। হার্টের সমস্যা, গ্যাসের সমস্যা নানা টেস্ট করার পর ধরা পড়ছে, এখানে ভিলেন স্পন্ডেলাইটিস।
এর থেকে বাঁচার উপায়?
ডাঃ পালের মত, গাড়ির সঙ্গে নিজের শরীরের যত্ন নিতে হবে। বয়স তিরিশ পেরোলেই, বিশেষ করে যারা বেশি মোটরবাইক চালান, তাঁদের নিজেদের স্বাস্থ্যের চেক আপ করাতে হবে। তবে ওষুধ নির্ভর জীবন হোক এটা একদমই বলবো না। সুষম আহার, আর রেগুলার শরীরচর্চা জরুরি। বাইকারদের জন্য, ঘাড়ের ও কোমরের ব্যায়াম অবশ্যই জরুরি।
এর পাশাপাশি মাথায় রাখতে হবে। আত্মবিশ্বাস বুঝে, দৈনিক কতটা গাড়ি চালাবো, সেটা ঠিক করে নেওয়া। আবেগে অতিরিক্ত কিলোমিটার জার্নি প্রাণঘাতী হয়। আবার অনেক সময় দেখা গিয়েছে, দীর্ঘ জার্নি করতে গিয়ে, শরীরে জলের অভাব বোধ করছে, মাসল টান ধরছে, কিন্তু এমন একটা সময় এই টান ধরে, তখন ব্রেক কষারও সুযোগ দেয় না। ফলে একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর যেমন গাড়িতে বিরতি দিতে হয়, তেমন শরীরকেও বিরতি দিতে হয়।