সাগর সেন–প্রথমেই বলি এটি আদতে একটি অতি খাজা পোস্ট। কোন রাজা গজার ব্যপারই নেই, তাও ক্ষমাঘেন্না করে পড়ে দেখতে পারেন। দেখুন আমার ধারণায় বাঙালী পুরী যায় মোটামুটি তিনটি কারণে। এর বাইরেও আরো কারণ থাকতে পারে অবশ্যই, কিন্তু এই তিনটিই যাকে বলে আসল।
পুরীর সমুদ্র আর জগন্নাথদেবের দর্শন এদুটোতো আছেই, চোখ বুজে বলে দেওয়া যায়। তৃতীয় কারণটি আন্দাজ করুন তো দেখি? আমার মতে এর উত্তর হচ্ছে খাজা। হ্যাঁ, আদি ও অকৃত্রিম পুরীর খাজা। আমার অভিজ্ঞতায় বলে পুরীর খাজা শুনলেই বাঙালী রীতিমতো উত্তেজিত এবং লালায়িত হয়ে পড়ে। পুরীর খাজা ওড়িয়ারা যত না খান আমি নিশ্চিত বাঙালীরা তার চেয়ে অনেক বেশি খান এবং পুরীর খাজা ইন্ডাস্ট্রি বিরাট ভাবে বঙ্গনির্ভর।
যাঁরা পুরী গেছেন এবং গিয়ে থাকেন, তাঁদের নিশ্চয়ই অভিজ্ঞতা আছে, পুরীযাত্রার কথা উঠলেই পরিবার-পরিজন আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব সব্বার দিক থেকে অনুরোধ ধেয়ে আসে খাজা নিয়ে আসার জন্য। অতএব পুরী গেলে শুধু খাজা খাওয়া নয়, ফেরার সময় ছাঁদা বেঁধে নিয়ে আসাটাও দস্তুর। এবার আসে আসল প্রশ্ন।
পুরীতে সেরা খাজা কোথায় পাওয়া যায়?
পুরীর খাজার জগতে আমি মোটামুটি তিনটি নাম শুনে আসছি। একটা নৃসিংহ, দ্বিতীয়টি গাঙ্গুরাম এবং তৃতীয়টি আদি ও অকৃত্রিম কাকাতুয়া। তবে সেই কাকাতুয়া বহুদিন দেহ রেখেছে আর শুনলাম তার সঙ্গে তাদের কোয়ালিটিও। তাহলে রুল অফ এলিমিনেশনে বেঁচে রইল নৃসিংহ এবং গাঙ্গুরাম।
গাঙ্গুরাম নিয়েও নানা রকম মিক্সড রিভিউ আছে, আমি নিজেও আগে গাঙ্গুরামের দোকান থেকে খাজা কিনেছি কিন্তু সেটা যে কোন দোকান তা আর কিছুতেই মনে করতে পারলাম না। সেটা খুব একটা খারাপও ছিল না। তবে জনান্তিকে শুনলাম ইদানিং নৃসিংহই নাকি সেরা। তাই গাঙ্গুরামও বাদ। এবারের পুরী ট্রীপে মিশন নৃসিংহ।
তবে গেলাম, দেখলাম, কিনে ফেললাম, ব্যপারটা অত সরল নয়। সেই হাজার হাজার ডাক্তার হাজরার মত পুরীতে হাজার হাজার নৃসিংহ। এর মধ্যে আদি এবং আসল নৃসিংহকে খুঁজে বার করতে হবে, তবেই নাকি মিলবে সেরা খাজার স্বাদ। সে এক বিষম কঠিন ব্যপার, মগজাস্ত্রের প্রয়োগ বিধেয়।

এক শরৎ সন্ধ্যায় আশায় বুক বেঁধে ঢুকে পড়লাম খাজাপট্টিতে।স্বর্গদ্বার থেকে এগিয়ে শ্রী চৈতন্য দেবের মূর্তিকে বাঁদিকে রেখে যে রাস্তাটা ভিতরে ঢুকে বাঁক নিয়ে মন্দিরের দিকে চলে গেছে ওই দিকেই খাজা পট্টি। ঢুকলেই দেখা যাবে চতুর্দিকে অসংখ্য খাজার দোকান, মানে খাজাই খাজা, কত খাবি নিয়ে যা, টাইপের ব্যপার।
এবারে ফুল কনফিউশন। গুচ্ছ গুচ্ছ দোকান, যেদিকেই তাকাই সেদিকেই সাইনবোর্ডে হয় গাঙ্গুরাম আর নয় নৃসিংহ লেখা। সবারই দাবি তারাই আদি এবং তারাই আসল। এত আসলের ভিড়ে মাথা ঘুরে যাওয়ার যোগাড়। ভেবেচিন্তে ঠিক করলাম স্থানীয় কাউকে পাকড়াও করতে হবে, আবার এমন লোক হলে চলবে না যার ভেস্টেড ইন্টেরেস্ট আছে, ভুলভাল খাজার দোকানে ভিড়িয়ে দেবে।
অবশেষে তাকবাক করে, বেশ খানিকক্ষণ এদিক ওদিক দেখে, একজন বয়স্ক মানুষকে পাকড়াও করলাম। দুটি খাজার দোকানের মাঝে তাঁর শঙখ, ঝিনুকের মালা এইসবের এক ফালি দোকান। তাঁকেই গিয়ে অত্যন্ত বিনয়ী গলায় জিজ্ঞাসা করলাম আসল নৃসিংহর দোকানটা কোথায়? উনিই বাতলে দিলেন।
এই রাস্তা সিধা যাই ভারত সেবাশ্রম সংঘ বাঁ কু রাখিকি মন্দির আরুকু চালিলে, আপনকুরু বাঁদিকেরে ন্রুসিংহ সুইটসরে দোকান পাইবে। পদ্মিনী লজের তলে দোকানটা অছি। ব্যস আর কি, ওনার কথামতো হেঁটে গিয়ে পৌঁছে গেলাম বহুকাঙ্ক্ষিত দোকানে।

সে বেশ ঝলমলে বড়োসড়ো দোকান, দেখলে শ্রদ্ধা জাগবে, সেইরকম। শোকেস এর উপর সারি সারি খাজা ভর্তি ট্রে সাজানো রয়েছে। দোকানে বেশ ভিড় আর ধুম বিক্রি। মুহূর্মুহু ট্রে খালি হচ্ছে আবার ভিতর থেকে ঝুড়িভর্তি গরম গরম খাজা তৈরী হয়ে আসছে আর ট্রে তে উপুড় করে দেওয়া হচ্ছে।
ঠেলেঠুলে শোকেসের সামনে পৌঁছে বুঝলাম চার রকম দামের এবং মানের খাজা আছে। দাম ১৬০, ১৮০, ২০০ আর সেরা খাজাটি ৪০০ টাকা কেজি, সেটি খাঁটি ঘিয়ে ভাজা। তবে শুধুই খাজা নয়, এদের দোকানে বেশ লোভনীয় কিছু মিষ্টি রয়েছে দেখলাম।
ছানাপোড়া, ক্ষীর, কমলাভোগ, ছানার জিলিপী, পরপর গামলায় সাজানো, চেহারাচরিত্র চোখে দেখেই মনে হচ্ছে জম্পেশ হবে। ছানার মালপোয়া ছিল, একটা ট্রাই করলাম, খুবই ভালো খেতে। পেঁড়াও ট্রাই করেছি, তবে সেটা এমন কিছু নয়, অ্যাভারেজ টেস্ট। এবার যার জন্য যাওয়া, সেই খাজার কথা বলি। চারশো টাকার কেজির যে খাজা সেটি অত্যন্ত ভালো খেতে, খাস্তা আর একদম মুচমুচে, মুখে দিলে মিলিয়ে যাচ্ছে। ঘিয়ের ফ্লেভারটা পাওয়া যায়। খুব কড়া মিষ্টি যে তাও নয়। কম দামের গুলো অবশ্য ট্রাই করিনি, তাই বলতে পারবো না।
তাই জয় জগন্নাথ বলে চারশো টাকারটাই তুলে নিলাম। নিজের আর অর্ডারি মাল মিলে যা পরিমাণ দাঁড়ালো তাতে গাড়ির ডিকি নয়, ছোটা হাতিতে নিয়ে আসতে পারলে ভালো হত৷ ফিরে গিয়ে যদি লোকজনকে না দিতাম কলকাতায় অনায়াসে একটা ছোটখাটো খাজার দোকান খুলে ফেলা যেত। জগন্নাথদেবের কৃপায় দুপয়সা কামাই হত।
কিন্তু মরদ কা বাত হাতি কা দাঁত, যাদের যাদের ভরসা দিয়েছি খাজা নিয়েই ফিরবো তাদের কাউকেই হতাশ করিনি। ওভারঅল নৃসিংহের খাজা হিট, যাঁদেরই দিয়েছি মুক্তকন্ঠে প্রশংসা করেছেন। ইতিমধ্যেই খাজা কনসালট্যান্ট হিসেবে বাজারে আমার কিছুটা নামও হয়েছে৷
যাইহোক আপনাদেরও বলে দিলাম, এর পর পুরী গেলে আদি নৃসিংহের খাজা নিতেই পারেন, ঠকবেন না, উপরন্তু লোকজনের ভরপুর আশীর্ব্বাদ পাবেন। সুতরাং খাজা খান এবং খাওয়ান।
আমার কথাটি ফুরোলো, নটে গাছটি মুড়োল।
ছবি প্রতিবেদকের তোলা– লেখক পেশায় ব্যাঙ্ককর্মী। বেড়াতে ভালোবাসেন এবং ফুড নিয়েও লেখালেখি করেন। তাঁর ইউটিউব চ্যানেলের লিঙ্ক নীচে দেওয়া হল।