Breaking News

হংসেশ্বরী মন্দির ও নবরত্ন স্থাপত্য: এক ঐতিহাসিক ও স্থাপত্যগত গবেষণা

ভূমিকা

হুগলির বান্দেল সংলগ্ন বাঁশবেড়িয়া অঞ্চলে অবস্থিত হংসেশ্বরী মন্দির পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম স্থাপত্যশৈলীর অনন্য নিদর্শন। ১৮০১ সালে নির্মিত এই মন্দিরটি শুধুমাত্র ধর্মীয় উপাসনার স্থান নয়, এটি বাংলার স্থাপত্যশিল্পের বিবর্তনের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। মন্দিরের নবরত্ন শৈলী, ঐতিহাসিক পটভূমি, এবং এর নির্মাণকৌশল একে অন্য যে কোনো মন্দির থেকে স্বতন্ত্র করে তুলেছে।

ইতিহাস ও প্রতিষ্ঠা

হংসেশ্বরী মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন হুগলির জমিদার রাজা নৃসিংহদেব রায় মাহাশয়। ১৮০১ সালে এই মন্দির নির্মাণ শুরু হলেও, এটি সম্পূর্ণ হয় ১৮১৪ সালে, নৃসিংহদেবের মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী রানী শঙ্করী দেবীর তত্ত্বাবধানে। এই মন্দির নির্মাণের অনুপ্রেরণা সম্পর্কে জানা যায় যে, নৃসিংহদেব সাধনার মাধ্যমে দেবী হংসেশ্বরীর স্বপ্নাদেশ পান এবং তারপরেই তিনি এই মন্দির নির্মাণের উদ্যোগ নেন।

স্থাপত্যশৈলী ও বৈশিষ্ট্য

হংসেশ্বরী মন্দির বাংলার প্রচলিত নবদ্বীপ, বিষ্ণুপুর, কিংবা দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দিরের স্থাপত্যশৈলীর থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। মন্দিরের বিশেষত্ব নিম্নরূপ—

১. নবরত্ন কাঠামো

এই মন্দিরের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এর উঁচু, গম্বুজাকৃতির নয়টি চূড়া (রত্ন)। সাধারণ নবরত্ন মন্দিরের চূড়া গুলি পিরামিডের মতো হলেও, হংসেশ্বরী মন্দিরের চূড়াগুলি পদ্মকলি আকৃতির, যা বাংলায় খুব কম দেখা যায়।

২. তন্ত্র সাধনার প্রভাব

মন্দিরের কাঠামো নির্মিত হয়েছে তন্ত্রসাধনার আদলে। কথিত আছে, দেবী হংসেশ্বরী হলেন যোগশাস্ত্র ও তন্ত্রের এক বিশেষ রূপ, যেখানে মানব দেহের চক্রতত্ত্ব অনুসারে স্থাপত্যশৈলী গঠিত হয়েছে।

৩. ইন্দো-রুশ স্থাপত্যের মিশ্রণ

মন্দিরের গঠনশৈলীতে ভারতীয় ঐতিহ্যের পাশাপাশি রুশ স্থাপত্যের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। বিশেষত, এর থামের গঠন ও চূড়ার বিন্যাস রাশিয়ার প্রাচীন চার্চগুলির অনুরূপ।

৪. নির্মাণ উপাদান ও শৈল্পিক সৌন্দর্য

মন্দিরের নির্মাণে প্রধানত চুন-সুরকি ও লাল ইট ব্যবহৃত হয়েছে। ভেতরের অংশ বেশ শীতল, যা প্রাকৃতিকভাবেই তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে।

ধর্মীয় গুরুত্ব ও উপাসনার রীতি

মন্দিরে দেবী হংসেশ্বরীর বিগ্রহ স্থাপিত, যিনি মা কালী ও দেবী দুর্গার অপর এক রূপ। দেবী সাধারণত শ্বেত বস্ত্র পরিহিতা, যার ফলে তিনি “হংস” (সাদা রাজহাঁস) নামক বিশেষণের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন।

প্রতিদিন সকাল-বিকেলে পুজো হয়, তবে বিশেষ করে কালীপূজা, দুর্গাপূজা, ও মাঘী পূর্ণিমায় এখানে ব্যাপক ভক্তসমাগম ঘটে।

সাম্প্রতিক সংরক্ষণ ও পর্যটন গুরুত্ব

বর্তমানে হুগলি জেলা প্রশাসন ও পশ্চিমবঙ্গ প্রত্নতত্ত্ব দপ্তর এই মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নিয়েছে। মন্দিরের আশপাশে পর্যটকদের জন্য গাইড ও ব্যাখ্যা সংবলিত বোর্ড বসানো হয়েছে।

প্রতি বছর অসংখ্য পর্যটক ও গবেষক এই মন্দির পরিদর্শন করেন, বিশেষত যারা বাংলার প্রাচীন স্থাপত্য ও তন্ত্রসাধনা নিয়ে গবেষণা করেন।

উপসংহার

হংসেশ্বরী মন্দির শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় কেন্দ্র নয়, এটি বাংলার ঐতিহাসিক স্থাপত্যের একটি অমূল্য নিদর্শন। এর ব্যতিক্রমী নবরত্ন শৈলী, তন্ত্রসাধনার ভিত্তিতে গঠিত কাঠামো, এবং রুশ স্থাপত্যের ছোঁয়া একে অন্যান্য মন্দির থেকে স্বতন্ত্র করে তুলেছে। সংরক্ষণ ও প্রচারের মাধ্যমে এই মন্দির বাংলার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে আরও সমৃদ্ধ করতে পারে।

আমাদের চ্যানেলে যুক্ত হয়ে যান

About Orbit News

Check Also

বর্ধমানের সর্বমঙ্গলা মন্দির: এক জাগ্রত দেবী মন্দির, আসল রহস্য কী!

মন্দিরের পরিচিতি পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান শহরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ তীর্থস্থান হল সর্বমঙ্গলা মন্দির। এটি কেবলমাত্র একটি ধর্মীয় …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!