পূর্ণেন্দু ব্যানার্জি–কলকাতা শহরের দক্ষিণে হুগলি নদীর প্রবাহকে মোটামুটি চারটি স্তরে ভাগ করা যায়। ফোর্ট উইলিয়ম থেকে উলুবেড়িয়া পর্যন্ত প্রায় ২০ মাইল নদীর প্রবাহ দক্ষিণ পশ্চিমমুখী। উলুবেড়িয়া থেকে তার পরবর্তী ২০ মাইল নদী দক্ষিণ মুখী। এখানেই হুগলি পয়েন্ট। হুগলি পয়েন্ট থেকে অর্ধবৃত্তাকারে প্রায় ২৫ মাইল ব্যাপী নদী প্রবাহের মধ্যে ডায়মন্ড হারবার।
তারপর সাগর সঙ্গমে ভাগীরথির যাত্রা শুরু হয়েছে বলা চলে। যাত্রাপথের বাঁ পাশে সাগরদ্বীপ। ফোর্ট উইলিয়ম ও উলিবেড়িয়া থেকে দক্ষিণে যাত্রাপথে ডানদিক থেকে একাধিক নদীর ধারা এসে মিলিত হয়েছে ভাগীরথির বুকে। তারমধ্যে দামোদর, রূপনারায়ণ, হলদি ও রসুলপুর নদী প্রধান। সর্বপ্রধান হল রূপনায়ারণ এবং ভাগীরথী ও রূপনারায়ণের সঙ্গমস্থলকে বলে হুগলি পয়েন্ট।

এখানে নদীর বাঁক সবচেয়ে ভয়ঙ্কর। অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে সমস্ত বিদেশী নাবিকেরা এই কুখ্যাত বাঁককে শঙ্কিত চিত্রে স্মরণ করে এসেছেন। ষোড়শ শতাব্দীর প্রাচীন মানচিত্রে দেখা যায় (ডি ব্যারেজের) খেজুরি ও হিলজির অবস্থান প্রদেশে একটি দ্বীপের অভ্যুত্থান হচ্ছে বোঝা যায়, সমুদ্র গর্ভের চড়া থেকে খেজুরি, হিজলির জন্ম প্রায় এই সময়। সপ্তদশ শতাব্দীর মানচিত্রে বোঝা যায় (যেমন ভ্যান্টিনের, বাউরি প্রভৃতির), দুটি স্বতন্ত্র দ্বীপাকারে নির্দিষ্ট হয়েছে। খেজুরি ওহিজলির মাঝখানে ছিল কাউখালি নদী। কাউখালি বাতিঘরটি ছিল মধ্যপথে।
আরও পড়ুন- চুয়াড়বিদ্রোহের সময় নাড়াজোলের রানিদের সঙ্গে কী হয়েছিল?
এখন কাউখালি নদী হয়তো খাল রূপে বিরাজ করছে। নাম কুঞ্জপুর খাল। একসময়ে সমস্ত অঞ্চল প্রায় জল ডুবে থাকতো। আগাগোড়া টানা উঁচু বাঁধ দিয়ে লবনাক্ত জলের গতিরোধ করে এখন জমি বাসযোগ্য ও আবাদযোগ্য করা হয়েছে। লক্ষ্যণীয় হল, খেজুরির উপকূল অঞ্চল পৌন্ড্র ক্ষত্রিয় প্রধান, এবং উত্তরাঞ্চল মাহিষ্য প্রধান। দক্ষিণ ২৪ পরগনাও পৌন্ড্র ক্ষত্রিয় প্রধান, মধ্যবর্তা দ্বীপগুলিও তাই।
খেজুরির সঙ্গে দক্ষিণ ২৪ পরগনার ও সাগরদ্বীপের ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্কও রয়েছে। নবাবী আমলে অন্যতম প্রধান নিমকমহল ছিল এই অঞ্চল। নীচু জলা জায়গায় জলের অভাব ছিল না এবং লোনা জল। লবন তৈরির সুবিধা ছিল সবদিক থেকে। বুনো শুয়োর, মোষ, হরিণ, বাঘ প্রভৃতি জীবজন্তুর অভাব ছিল না। পৌন্ড্র ক্ষত্রিয়রাই এখানকার বিশেষ করে উপকূল অঞ্চলে আদি বাসিন্দা ছিলেন বলে মনে হয়।

কলকাতা শহরের প্রতিষ্ঠাতা জোব চার্নক সাহেব হুগলি থেকে বিতাড়িত হয়ে সুতানুটিতে এসেছিলেন। এবং সুতানুটি থেকে খেজুরি ও হিজলিতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেখানে তাঁকে যুদ্ধও করতে হয়। তখন খেজুরি ও হিজলির অবস্থা ছিল অন্যরকম । জলা জঙ্গল ও বন্য জন্তুতে ভরা ছিল এইসব অঞ্চল।
সুতানুটি, গোবিন্দপুর, কলিকাতা গ্রামের পরবর্তী ইতিহাসের রোমান্টিক আলোয় খেজুরি ও হিজলির ইতিহাস অনেকটা ম্লান হয়ে গিয়েছে। কিন্তু একসময়, আজ থেকে প্রায় ৩০০ বছর আগে, জন কোম্পানির ভাগ্য নিয়ে জুয়া খেলার সময়, এই স্থান দুটির গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ভূমিকা ছিল।
আরও পড়ুন- জানেন কি মেদিনীপুরের গনগনির আসল ইতিহাস
খেজুরি ও হিজলির কোনও স্থান দেখে আজ বোঝার উপায় নেই, ঐতিহাসিক নিদর্শন প্রায় লুপ্ত সামান্য কয়েকটি ধ্বংসচিহ্ন আছে মাত্র। যা দেখে অতীতের ইতিহাস কল্পনা করতে হয়। সমুদ্র পথে বালেশ্বর থেকে খেজুরি পর্যন্ত ইংরেজ নাবিকদের যাতায়াত করতে হত তখন। ফ্যাক্টরি রেকর্ডে হেজেস ও স্টেনশ্যাম মাস্টার্সদের ডায়েরিতে খেজুরির এই পথের অনেকটা চমকপ্রদ বিবরণ পাওয়া যায়।
বাংলা থেকে সমুদ্রপথে যাত্রার মুখেই ছিল খেজুরি। বিশেষ করে হুগলি ও কলকাতা থেকে। কলকাতা শহরের গোড়াপত্তনের সঙ্গে সঙ্গে জোব চার্নকের আমল থেকেই খেজুরি একটি বন্দর ও প্রধান স্টেশন হয়ে ওঠে। একটি এজেন্ট হাউস ও পোর্ট অফিস খেজুরিতে তৈরি হয়। অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যে খেজুরি একটি টাউনের মতো গড়ে ওঠে। সাহেবদের বসবাসের জন্য ঘরবাড়িও তৈরি হয়।

আট বিঘা জমির উপর এইরকম বারান্দা হলঘর, উপরের ঘরসহ প্রকাণ্ড বাড়ি তখন খেজুরিতে একাধিক তৈরি হয়েছিল। এখনও দু একটি পুরনো বাড়ি রয়েছে। কিন্তু ১৭৯২ সালে যে বাড়ি নিলাম হয়েছিল, সেইরকম একটিও বাড়ির চিহ্ন নেই। বিদেশী বণিক ও নাবিকদের প্রধান বিশ্রাম ও আড্ডার স্থান ছিল খেজুরি ঘরবাড়ি বন্দর, আফিস, এজেন্ট হাউস, পোস্ট অফিসতো ছিলই, তার সঙ্গে সেকালের ট্যাভর্ন ও হোটেল ছিল।
আরও পড়ুন- হাজার বছরের পুরনো বাংলার
প্রচীন দশাবতার তাস খেলার কৌশল জানেন?
বিদেশীদের এমন কোনও বাণিজ্যকেন্দ্র, বসবাসকেন্দ্র ও বন্দর ছিল না, যেখানে ট্যাভার্ন, কফিহাউস বা হোটেল ছিল না। কলকাতা শহরে ছিল, শ্রীরামপুরে ছিল, হুগলিতে ছিল, খেজুরিতেও ছিল। বিখ্যাত সব ট্যাভার্ন। কলকাতার কসাইতলা ও এসপ্লানেড অঞ্চল ট্যাভার্ন ও কফিহাউসের নাচে গানে যেমন সরগরম হয়ে থাকতো। খেজুরির বন্দরনগরও তাই থাকতো। সেই সব ট্যাভার্নতো নেই, বরং বর্তমানে যা রয়েছে যেন এক ভৌতিক নগর।
মগ-ফিরিঙ্গি, (আরাকানি ও পর্তুগিজ) জলদস্যু বিধ্বস্ত, বন্যজন্তু উপদ্রুত খেজুরি অঞ্চল মানুষের বাসোপযোগী হয়ে ওঠে কোম্পানির আমল থেকে। কলকাতায় যখন বন্দর হয়নি, খেজুরিতে তখন বন্দর ছিল। বড় বড় মালবোঝাই জাহাজ যখন কলকাতার গঙ্গার ঘাটে আসতো না, তখন খেজুরির উপকূলে তারা নোঙর বেঁধে অবস্থান করতো। মালপত্র বোঝাই ও খালাস করা হত খেজুরিতে। তারপর খেজুরি থেকে স্নুপে করে মালপত্র যাতায়াত করতো কলকাতায়।
শহর কলকাতার বাল্য জীবনে তাই বন্দর খেজুরির গুরুত্ব ছিল বেশ বড়। সেখানে নগর গড়ে ওঠা স্বাভাবিক, কেবল বন্দর বা পোতাশ্রয় বলে নয়। বীরকুল, খেজুরি, হিজলি, কাঁথি- এসব অঞ্চল ছিল তখন স্থাস্থ্য পুনরুদ্ধারের প্রধান স্থান। দার্জিলিং পুরী গোপালপুর তখনও সাহেবদের স্বাস্থ্য নিবাস কেন্দ্রে পরিণত হয়নি।
বাংলার প্রচীন রাজা চন্দ্রবর্মণের গড় সম্পর্কে জানতে ইউটিউবে,
Travel Tv Bangla-র ভিডিও দেখুন ও চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব করুন
বীরকুল, খেজুরি, হিজলি অঞ্চলেই, তখন তারা স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের জন্য যেতেন। অনেকে গিয়ে আর ফিরতেন না, খেজুরিতেই দেহ রাখতেন। এমন অনেক বিদেশী নাবিক, কর্মচারীর দেহ খেজুরিতে সমাধিস্থ হয়েছে তার ঠিক নেই।
আমাদের এই বিকল্পধর্মী ইতিহাস ও সংস্কৃতিমূলক খবর কেমন লাগছে?
ভালো লাগলে আমাদের খবরের গ্রুপে যুক্ত হয়ে যেতে পারেন। লিঙ্কে ক্লিক করুন