পূর্ণেন্দু ব্যানার্জি– বাংলার বুকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ইতিহাস ও তার ধ্বংসপ্রাপ্ত স্থাপত্য। ভিনরাজ্যে রাজপুত, মুঘল, আফগানদের ইতিহাস যেভাবে সংরক্ষিত হয়েছে বাংলায় হয়তো তার অভাব অনেকটাই লক্ষ্য করা যায়। অথচ দেশের স্বাধীনতা থেকে প্রচীন লোক কৃষ্টির রসদ এ বঙ্গে কম কিছু নেই।
আজকের পর্বে থাকছে নাড়াজোল রাজবাড়ির কিছু ইতিহাস। গবেষকদের মত, কর্ণগড়ের মতো নাড়াজোল রাজবাড়ির রাজবংশ ছিল সদগোপ। কর্ণগড়ের রাজবংশ যখন অস্তাচলে, সেই সময়ই জন্ম নিচ্ছে নাড়াজোল রাজবংশ। এই রাজবংশের আদি পুরুষ ছিলেন উদয়নারায়ণ ঘোষ। উদয়নারায়ণের প্রপৌত্র কার্তিকরাম মুঘল সম্রাটের কাছে রাজা উপাধি পান। তারপর এই বংশের অষ্টমপুরুষ বলবন্ত রায় উপাধি পরিবর্তন করে খাঁ হন। জানা যায়, কোনও প্রশংসামূলক কাজের জন্যই তাঁর এই উপাধি।

নাড়াজোল রাজবাড়ির গড়ের চৌহদ্দি প্রায় ৫০০ বিঘার মতো ছিল। গড় দুটি ভাগে বিভক্ত ছিল, অন্তর ও বাহির। গড়ের বহু স্থাপত্য আজ ধ্বংসপ্রাপ্ত। যদিও প্রমাণ্য তথ্য বলছে, রাজবাড়ির অন্তরগড়ে একাধিক অট্টালিকা, মন্দির, পুজোর দালান, বৈঠকখানা, তোষাখানা, সদরমহল, অন্দরমহল প্রায় যেন ইন্দ্রপুরী। প্রবেশপথে একটি বড় তোরণ, দুপাশে স্তম্ভ ও নহবতখানা, প্রাঙ্গনে কুলজদেবতা সীতারাম জিউর মন্দির।
আরও পড়ুন- গনগনি বেড়াতে গেছেন? জানেন তার আসল ইতিহাস?
কর্ণগড়ের শেষ রাজা অজিত সিংহ নিঃসন্তান অবস্থায় মারা যান। এবং তাঁর দুই রানি ভবানী ও শিরোমনি ১১৬২ বঙ্গাব্দে মেদিনীপুর রাজ্য লাভ করেন। চুয়াড়বিদ্রোহের সময় দলপতি গোবর্ধন দিকপতি রাজবাড়ি দখল করে নেন। রানিরা দুজনেই নাড়াজোলের রাজা ত্রিলোচন খাঁয়ের আশ্রয় নেন।
যেখানে তাঁরা দেখা করেছিলেন, সেই জায়গাটি রানি পাটনা নামে খ্যাত। ত্রিলোচন কথা দেন, চুয়াড়দের শায়েস্তা করবেন। এবং রানিদের আবাসস্থল উদ্ধার করে দেবেন। রানিরাও খুশি হয়ে একটি অঙ্গিকারপত্র লিখে দেন। সেটি অছিয়তন একরার নামে খ্যাত।
১১৬৭ বঙ্গাব্দে রানি ভবানীর মৃত্যু হয়। ত্রিলোচনের মৃত্যুর পর ভাইপো মতিরাম খান রানি শিরোমনির তত্ত্বাবধায়ক হন। মতিরামের মৃত্যুর পর কাকার ছেলে রাজ্যের রক্ষক হন। সীতারামের তিন পুত্র আনন্দলাল, নন্দলাল, মোহনলাল।
উইকেন্ড হোক বা দেশ বিদেশ ভালো ভাবে বেড়াতে যোগাযোগ করুন আমাদের সঙ্গে 9073503958

আনন্দলালকে রানি শিরোমনি পুত্রের মতো স্নেহ করতেন। ১২০৭ বঙ্গাব্দের ১৯ আষাঢ় একটি হেবেনামা দ্বারা রানি শিরোমনি সমস্ত রাজ্য আনন্দলালকে অর্পণ করেন। ১২১৯ বঙ্গাব্দে রানি শিরোমনির মৃত্যু হয়, এবং তার দু বছর আগে ১২১৭ বঙ্গাব্দে আনন্দলাল নিঃসন্তান অবস্থায় মারা যান।
পত্র দ্বারা আনন্দলাল, ছোট ভাই মোহনলাল খানকে মেদিনীপুর রাজ্য এবং মধ্যম ভাই নন্দলালকে নাড়াজোল রাজ্য দিয়ে যান। রাজা রানি ও এ রাজ্যের কাহিনি আজ স্তব্ধ। যেমন রাজবাড়ির পরিত্যক্ত কামানগুলি নিস্তব্ধ। যেমন রাজাদের শাক্ত, শৈব, বৈষ্ণব দেবদেবীরা সকলে আজ নিস্তব্ধ। নিস্তব্ধ নয় কেবল সেই জঙ্গলের চুয়াড়দের বংশধরেরা। যারা মাঝে মধ্যে কোলাহল করে নির্বাক অতীতকে কথা বলাতে চায়।