পূর্ণেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়-বিশ্বের ইতিহাসে যে প্রচীন মহাকাব্যগুলি এখনও বেঁচে রয়েছে, তাদের মধ্যে অন্যতম রামায়ণ ও মহাভারত। প্রাচীন ভারতের এই দুই মহাকাব্যকে ঘিরে বিস্তর বিতর্ক রয়েছে, এগুলিকি স্রেফ সাহিত্য! নাকি এর অন্তরালে রয়েছে ইতিহাস।
এমন বিতর্ক ছিল হোমারের ইলিয়াড ওডিসিকে ঘিরেও। একটা সময় পর্যন্ত ইতিহাস গবেষকেরা মানতেই চাননি ইলিয়াড ওডিসি কোনও ইতিহাসের অঙ্গ হতে পারে। কিন্তু ইতিহাস যে রূপেই বেঁচে থাক, সময়ের গর্ভ থেকে কোনও না কোনও প্রজন্মের হাত ধরে বলিয়ান হয়ে ওঠে। এমনই এক কাহানি খাস তুরস্কে ভূমিতে। ট্রয় নগরী আবিষ্কারের পরেই সাহিত্য রূপ বদলায় ইতিহাসে।
গ্রিক পৌরাণিক কাহিনির অন্যতম অংশ ট্রয় যুদ্ধ ও ট্রয় নগরী ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কাহিনি। মূল কাহানি আমরা অনেকেই হয়তো পড়েছি বা শুনেছি, কিন্তু এর পিছনে যে ইতিহাস লুকিয়ে আছে তা বেশ চিত্তচাঞ্চল্যকর।
ট্রয় যুদ্ধের কথা
প্রচীন এশিয়ার বুকে অধুনা তুরস্কের আনাতোলায়া রাজ্যে অবস্থান করতো এক প্রাচীন নগর। এই নগরের রাজা ছিলেন প্রিয়াম ও রানি হেকবা। তাদের একমাত্র পুত্র ছিল প্যারিস। প্যারিস যখন যুবক, তখন স্পার্টা রাজ্যে রাজা মেনেলাসের স্ত্রী হেলেনের প্রেমে পড়েন। তিনি হেলেনকে নিয়ে ট্রয়ে পালিয়ে আসেন। ফল স্বরূপ দাঁড়ায় ট্রয় ও স্পার্টা রাজ্যের যুদ্ধ। কাহানি এতোটাই চমকপ্রদ ও রোমাঞ্কর যে গ্রিক ও রোমান সাহিত্যে বেশ বড় জায়গা করে নিয়েছে ট্রেয়ের যুদ্ধ। হোমারের পর, এই যুদ্ধ নিয়ে বহু প্রাচীন গল্প কাহানি তৈরি হয়েছে, লিখেছেন হেরোডেটাস, সফোক্লেস, রোমান কবি ভার্জিল ও ওভিড।

যুদ্ধের মূল কারণ
কারণ ছিল অত্যন্ত স্পষ্ট, প্যারিস অন্য রাজ্যের রানিকে তুলে নিয়ে আসবেন আর সেখানে যুদ্ধ হবে না একি হয়! এ কোনও অপহরণের কাহিনি নয়, ছিল নিছক প্রেম, হেলেন ভালোবাসার জন্যই প্যারিসের সঙ্গে স্পার্টা থেকে পালিয়ে আসেন। এর ফলেই যুদ্ধ।
হোমারের লেখনীতে মূল যে প্রতিপাদ্য বিষয় ফুটে উঠেছে, প্যারিস ও হেলেনের প্রেমের কাহানি। আর সেই প্রেম এতোটাই শক্তিশালী ছিল, আগামী দিনে কী হতে চলেছে, তার ভবিষ্যত চিন্তা না করেই সে স্বামী মেনেলাসকে ছেড়ে প্যারিসের হাত ধরে চলে এসেছিলেন। ফল হয়েছিল কল্পনার থেকেও বিচিত্র, স্পার্টার রাজা সর্বশক্তি দিয়ে আক্রমণ চালায়, দশ বছর ধরে যুদ্ধ চালায় ট্রেয়ের সঙ্গে। এর ফলে পুরো ট্রয় নগরী ধ্বংস হয়ে যায়।
এটাতো মূল কারণ, কিন্তু এর চিত্রনাট্যের পিছনে কি দেবতাদের কোনও হাত ছিল! গ্রিক পৌরাণিক কাহিনিতে বলা হয়েছে, পৃথিবীতে মানব জাতির সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছিল, ফলে চিন্তায় ছিলেন প্রধান দেবতা জিউস। তিনি চেয়েছিলেন, জনসংখ্যা কমাতে, আর একমাত্র যুদ্ধই, জনসংখ্যা কমাতে পারে। সেই চিন্তা থেকেই দেবতারা মানবজাতির ভবিত্যে ট্রয় যুদ্ধের চিত্রনাট্য লিখে দেন।
পৌরাণিক উপাদান
গ্রিসের পুরাণমতে, একবার স্বর্গে তিন দেবীর মধ্যে ঝগড়া হয়। তিন দেবী হলেন, এথেনা, হেরা ও আফ্রোদিতি। এদের ঝগড়ার সূত্রপাত ঘটান আর এক দেবী এরিস। গ্রিক পুরাণ মতে এরিসকে ঝগড়া, গণ্ডগোল পাকানোর দেবী হিসেবেই দেখা যায়। এরিস তিনদেবীকে একটি সোনার আপেল দেন, সেই আপেলে লেখা ছিল, শ্রেষ্ঠ সুন্দরীর জন্য। তিন দেবী আপেলের দাবিদার হলেন। শ্রেষ্ঠ সুন্দরী দেবীকে বেছে নিতে হবে, বিচারপর্বের দায় গেল দেবতাদের কাছে। কিন্তু কোনও দেবতা সাহস করে সিদ্ধান্ত জানাতে পারলেন না। অগত্যা দেবতাদের প্রধান জিউস, সিদ্ধান্ত নিলেন বিচারের ভার দেওয়া হবে মানবজাতির কাউকে। বাছাই করা হল, প্যারিসকে। ট্রয় নগরের রাজপুত্র।
প্যারিস তিন দেবীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ সুন্দরী হিসেবে বেছে নিলেন আফ্রোদিতিকে। তিনি খুশি হয়ে প্যারিসকে বর দিলেন। বললেন, মর্ত্যের শ্রেষ্ঠ সুন্দরী হবে তোমার ভালোবাসার পাত্রী। বলা বাহুল্য সেই সময় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুন্দরী ছিলেন হেলেন। যদিও তিনি ছিলেন স্পার্টারাজের রানি।
যদিও দেবীর বর মতো, হেলেন প্রেমে পড়লেন প্যারিসের। তারপর একদিন হেলেন স্পার্টা ছেড়ে পালিয়ে এলেন প্যারিসের হাত ধরে।
খবর স্পার্টা রাজ্যের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। ক্রোধে ফেটে পড়েন রাজা মেনেলাস। শুরু হয় ট্রেয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। প্রায় ১০ বছর ধরে চললো যুদ্ধ। এদিকে ট্রয় নগরীর বাসিন্দারাও হেলেনকে ছাড়তে নারাজ। কড়া প্রতিরোধ গড়ে তুললো তারা।

ট্রোজান হর্সের কাহানি
প্রায় একদশক ধরে যুদ্ধ চালানোর পর গ্রিকরা এক ছলের সাহায্য নিল। ট্রয় নগরীর বাইরে এক বিশালাকার ঘোড়া রেখে চলে যায়। ট্রেয়ের সৈন্যরাও দেখে, স্পার্টার সৈন্যরা নেই, সিংহ দরজায় পড়ে রয়েছে, কাঠের এক বিশালাকার ঘোড়া। তারা মনে করল, স্পার্টার রাজা হার স্বীকার করে এই ঘোড়াকে উপহার স্বরূপ ছেড়ে গিয়েছে। ট্রয়ের সৈন্যরা, ঘোড়াটিকে দুর্গের মধ্যে নিয়ে এলো। এরপরেই, ঘোড়া থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে স্পার্টার সৈন্য বেরিয়ে তুলকালাম করে তোলে। যাকে সামনে পায় তাকেই কাটতে থাকে।
অতর্কিতে আক্রমণে ট্রয়ের সৈন্যরাও দিশেহারা হয়ে যায়। মারা যায় প্যারিস, তার ভাই হেক্টর, অ্যকিলিস, অ্যাজাক্স। এই যুদ্ধের হত্যালীলা থেকে রেহাই দেওয়া হয়েছিল শিশু ও মহিলাদের। সেই সব অন্তঃপুরের মহিলাদের বন্দি করে দাসী বানানো হয়। এই ভাবে ধ্বংস হল এক প্রাচীন নগরের।
ট্রয় নগরের যুদ্ধের কাহানি সাহিত্যের মধ্যে থাকলেও একটা অংশের মানুষ বিশ্বাস করতেন এটি ইতিহাসের অঙ্গ। আধুনিক গবেষকরা অবশ্য তা খারিজ করে এসেছে। একাংশের অনুমান ট্রয়ের যুদ্ধ হয়েছিল ১৩০০ থেকে ১২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে।
কিন্তু ১৮৬৮ সালে হেনরিখ স্লিম্যান ও ফ্র্যাঙ্ক ক্যালভার্ট নামে দুই পুরাতত্ত্ব গবেষক, তুরস্কের হিসার্লিক অঞ্চলে এক প্রাচীন নগরের খোঁজ পান। সেখান থেকে যা উপকরণ মিলেছে, তা ট্রয় নগরীর সঙ্গে মিলে যায়। পরে আরও কিছু তথ্য প্রমাণে ঐতিহাসিক গবেষকেরা সিদ্ধান্তে আসেন, পৌরাণিক কাহিনিতে যে ট্রয় নগরের কথা রয়েছে, এটা সেই নগরী।