ভারতের অন্যতম শক্তিপীঠ এবং তান্ত্রিক সাধনার কেন্দ্র কামাখ্যা মন্দির আসামের গুয়াহাটির নীলাচল পাহাড়ে অবস্থিত। এটি শুধু ধর্মীয় নয়, সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। কামাখ্যা মন্দিরের মূল আরাধ্য দেবী হলেন দেবী কামাখ্যা বা শক্তি, যাকে নারীশক্তির প্রতীক হিসেবে পূজা করা হয়।
কামাখ্যা মন্দিরের ইতিহাস
কামাখ্যা মন্দিরের ইতিহাস প্রাচীন এবং রহস্যময়।
- পুরাণ অনুযায়ী উৎপত্তি: এটি হিন্দু পুরাণের ৫১টি শক্তিপীঠের মধ্যে একটি। কথিত আছে, সতীর দেহত্যাগের পর ভগবান শিব যখন তার দেহ বহন করছিলেন, তখন সতীর যোনি বা গোপনাঙ্গ এই স্থানে পড়েছিল। সেই কারণে মন্দিরটিকে নারীশক্তির এক অসাধারণ প্রতীক হিসেবে দেখা হয়।
- প্রাচীন স্থাপত্য: মন্দিরের প্রথম নির্মাণ ৮ম থেকে ৯ম শতাব্দীতে গুপ্ত যুগে শুরু হয় বলে মনে করা হয়। পরবর্তীতে কুচবিহারের রাজা নরনারায়ণ এবং তার ভাই চিলারায় এটি পুনর্নির্মাণ করেন।
- তান্ত্রিক প্রভাব: কামাখ্যা মন্দির তান্ত্রিক সাধনার এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। এখানে শক্তি পূজার বিভিন্ন তান্ত্রিক আচার-অনুষ্ঠান পরিচালিত হয়।
স্থাপত্যশৈলী
কামাখ্যা মন্দিরের স্থাপত্য নিও-ক্লাসিকাল এবং মধ্যযুগীয় শৈলীর মিশ্রণে গড়ে উঠেছে।
- গর্ভগৃহ: মন্দিরের মূল গর্ভগৃহ একটি গুহার মতো, যেখানে দেবীর মূর্তি নেই। পরিবর্তে, একটি যোনি-আকৃতির পাথর পূজিত হয়।
- শিখর: মন্দিরের শিখর হেমিসফেরিকাল আকারের, যা মধ্যযুগীয় কারুকার্যের একটি উদাহরণ।
- পরিক্রমা পথ: মন্দিরের আশপাশে ছোট ছোট মন্দির রয়েছে, যেখানে দশমহাবিদ্যা (দুর্গার দশ রূপ) পূজিত হন।
অম্বুবাচী উৎসব: কামাখ্যার প্রধান উৎসব
অম্বুবাচী উৎসব কামাখ্যা মন্দিরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তীর্থযাত্রা এবং উৎসব। এটি দেবী কামাখ্যার ঋতুচক্র বা মাসিক ঋতুস্রাব উদযাপন। দেবীর এই ঋতুচক্রকে প্রকৃতির উর্বরতা এবং সৃষ্টির প্রতীক হিসেবে ধরা হয়।
অম্বুবাচী উৎসবের সময়কাল
- কবে পালিত হয়: প্রতি বছর জুন মাসে, বর্ষাকালে (আষাঢ় মাস) এই উৎসব পালিত হয়।
- উদ্বোধন: সূর্যের মিথুন রাশিতে প্রবেশের সঙ্গে উৎসব শুরু হয়।
উৎসবের ধর্মীয় বিশ্বাস
অম্বুবাচীর সময় দেবী কামাখ্যার গর্ভগৃহ তিন দিন ধরে বন্ধ থাকে, কারণ এটি দেবীর ঋতুস্রাবের সময়। এই সময়ে মন্দিরে কোনো পূজা হয় না। চতুর্থ দিনে গর্ভগৃহ খোলা হয় এবং ভক্তরা দেবীর আশীর্বাদ লাভ করেন।
উৎসবের আচার-অনুষ্ঠান
- তান্ত্রিক সাধনা: তান্ত্রিকরা এই সময় কামাখ্যা মন্দিরে সমবেত হন এবং বিশেষ সাধনা করেন।
- প্রসাদ বিতরণ: দেবীর গর্ভগৃহ থেকে লাল রঙের পবিত্র কাপড় ভক্তদের মধ্যে বিতরণ করা হয়, যা অত্যন্ত শুভ বলে মনে করা হয়।
- জনসমাবেশ: লক্ষাধিক ভক্ত ভারত এবং বিদেশ থেকে আসেন এই উৎসবে অংশ নিতে। এটি এক বিশাল ধর্মীয় মিলনক্ষেত্র হয়ে ওঠে।
উৎসবের সামাজিক দিক
অম্বুবাচী উৎসব কেবল ধর্মীয় নয়, এটি নারীশক্তির প্রতি শ্রদ্ধা এবং প্রকৃতির উর্বরতাকে উদযাপনের উৎসব। এটি ঋতুচক্র এবং নারীত্বের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনকেও তুলে ধরে।
পর্যটন ও আয়োজন
অম্বুবাচী উৎসবে মন্দিরে বিশাল ভক্তসমাবেশ হয়। স্থানীয় প্রশাসন পর্যটকদের সুবিধার্থে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করে।
- পরিকাঠামো: অস্থায়ী শিবির, খাদ্য এবং পানীয়ের ব্যবস্থা।
- নিরাপত্তা: ভিড় নিয়ন্ত্রণের জন্য পুলিশ এবং স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী মোতায়েন।
- যোগাযোগ ব্যবস্থা:
- নিকটতম বিমানবন্দর: গোপীনাথ বরদলই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, গুয়াহাটি।
- রেলস্টেশন: গুয়াহাটি রেলওয়ে স্টেশন।
- সড়কপথে: গুয়াহাটি শহর থেকে মন্দিরে যানবাহনের সহজলভ্যতা।
উপসংহার
কামাখ্যা মন্দির এবং অম্বুবাচী উৎসব কেবল ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে গুরুত্বপূর্ণ নয়, এটি ভারতীয় সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের গভীরতা প্রকাশ করে। নারীত্ব, প্রকৃতি এবং সৃষ্টিশক্তির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের এটি এক মহৎ উদাহরণ। এই উৎসব প্রত্যেক বছর লক্ষাধিক ভক্তকে আকর্ষণ করে এবং তাদের আধ্যাত্মিক ও সামাজিক অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করে।
