অর্বিট হেল্থ– অনিয়মিত ঋতুস্রাব ডেকে আনতে পারে জটিল শারীরিক সমস্যা। আর সেটি যখন জটিল আকারে ধারণ করে, তখন শরিরে একাধিক রোগের নানা উপসর্গ দেখা দেয়। তবে নিজের শরীরের সমস্যাকে আগাম চিনতে পারলে, জটিল রোগে আগাম রাশ টানা যায়।
মহিলাদের মধ্যে কমন যে সমস্যাটি দেখা দেয় তা হল অনিয়মিত ঋতুস্রাব। আর এই সমস্যা বিভিন্ন কারণে হতে পারে। ফলে সমস্যাটিকে জানা বা বোঝা যেমন জরুরি, তেমনই দ্রুত এর পদক্ষেপ করাও জরুরি। আজকাল এই চিকিত্সার জন্য মডার্ন মেডিসিনে উপযুক্ত ব্যবস্থা রয়েছে। যদিও মডার্ন মেডিসিনের ওষুধ দীর্ঘদিন ব্যবহারের ফলে দীর্ঘমেয়াদী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। সেই জায়গায়, হোমিওপ্যাথি এবং আয়ুর্বেদিক অনেক বেশি নিরাপদ। তবে সবার আগে, কারণ অবশ্যই জানা জরুরি।
ঋতুস্রাবে প্রধানত ৬টি কারণ দেখা যায়। ১) ডিসমেনোরিয়া ২) অ্যামেনোরিয়া ৩) এন্ড্রোমেটরিয়াল ক্যান্সার ৪) ফাইব্রয়েড ৫) পেলভিড প্রদাহ জনিত সমস্যা ৬) মেনোরাজিয়া
ডিসমেনোরিয়া
ডিসমেনোরিয়া হল যন্ত্রণাদায়ক স্রাবকালীন খিঁচুনি। এটি দু ধরণের। প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি। প্রাইমারি হল স্রাবের সময় যন্ত্রণা। এটি ঋতুস্রাব হওয়া মহিলাদের সাধারণ সমস্যা। পেলভিক (যেমন এন্ডোমেট্রিওসিস) সমস্যা না থাকা সত্ত্বেও স্রাব শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তলপেটে টানটান যন্ত্রণা হলে একে ডিসমেনোরিয়া বলা হয়। সাধারণত ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে এই সমস্যা দেখা দেয়। বেশি মাত্রায় ডিসমেনোরিয়ার ঝুঁকিও জড়িত। অল্পবয়সে প্রথম ঋতুস্রাব, অনেক দিন ধরে স্রাব, ধূমপান, স্থুলতা এবং মদ্যপান এর কারণ হিসেবে ধরা হয়। অবৈজ্ঞানিক ভাবে ওজন কমানোর চেষ্টাও বেশি যন্ত্রণাদায়ক স্রাবের সঙ্গে জড়িত বলে ধরা হয়। সন্তানধারণের পর স্রাবকালীন যন্ত্রণা কমে – এমন ধারণা ঠিক নয়।
সেকেন্ডারি হল প্রোস্টাগ্ল্যান্ডিনস, জরায়ুর অতিরিক্ত সংকোচন বা অন্য কোনও রোগ থেকে হয়।
অ্যামেনোরিয়া
ঋতুস্রাব না হওয়াকে অ্যামেনোরিয়া বলে। অ্যামেনোরিয়া দুই রকমের হয়। প্রাইমারি এবং সেকেন্ডারি অ্যামেনোরিয়া। প্রাইমারি অ্যামেনোরিয়া হচ্ছে যখন একজন মহিলার কখনও ঋতুস্রাব হয়নি। সেকেন্ডারি অ্যামেনোরিয়া হচ্ছে এমন একটা অবস্থা যখন অন্তত ছ’মাস ঋতুস্রাব হয়নি। সেকেন্ডারি অ্যামেনোরিয়া সাধারণত গর্ভাবস্থার জন্য হয়।
আরও পড়ুন– চুল পড়ে যাচ্ছে ? জানুন সমাধান
মেনোরাজিয়া
মাত্রাতিরিক্ত এবং দীর্ঘসময় ধরে রজঃস্রাব হওয়াকে মেনোরাজিয়া বলে। একে হাইপার মেনোরিয়াও বলে। স্বাভাবিক ভাবে খুব বেশি রক্তস্রাব হলে তাকে মেনোরাজিয়া বলে না। সাত দিনের বেশি সময় ধরে রক্তপাত হতে থাকলে তাকে মেনোরাজিয়া বলা হয়ে থাকে। এই সময় বড় ডেলার আকারে জমা রক্ত সহ রজঃস্রাব হতে দেখা যায়। হরমোনের গণ্ডগোলে বা গর্ভাশয়ে ফাইব্রয়েড থাকার কারণে এই সমস্যা হয়ে থাকে।
এন্ডোমেট্রিয়াল ক্যান্সার
জরায়ুর ঝিল্লিতে ক্যান্সারকে এন্ডোমেট্রিয়াল ক্যান্সার বলে। এই ধরনের ক্যান্সার হলে যোনিনালি দিয়ে স্বাভাবিকের থেকে বেশি রক্তপাত হয়ে থাকে। এটি গুরুতর সমস্যা, তবে তাড়াতাড়ি ধরা পড়লে চিকিৎসায় নিরাময় সম্ভব। সাধারণত ৫০ বছরের উপর মহিলা বা যাদের ইস্ট্রোজেন হরমোনের মাত্রা বেশি, তাদের এই সমস্যা দেখা দিতে পারে।
ফাইব্রয়েড
জরায়ুর মাংসপেশীর দেওয়ালের বৃদ্ধি হল ফাইব্রয়েড। এগুলি খুব ছোট বা বড় নানা আকারে হয়। কিছু মহিলাদের ফাইব্রয়েডের কোনও লক্ষণ ধরা পড়ে না। অনেকের আবার দীর্ঘসময় অত্যাধিক রক্তপাত এবং স্বাভাবিকের থেকে বেশি স্রাব হয়। ফাইব্রয়েড হলে নিম্ন পেলভিক এলাকায় ব্যথা হয়ে থাকে। এর কারণে যৌনসংযোগের সময় ব্যথা হতে দেখা যায়। থেকে থেকেই প্রস্রাব পাচ্ছে বলে মনে হয়, কোষ্ঠবদ্ধতা হতে পারে। যে সব মহিলাদের বয়স ৩৫ বছরের বেশি বা যারা একাধিকবার গর্ভধারণ করেছেন তাদের ফাইব্রয়েডের ঝুঁকি থাকে বেশি।

পেলভিক প্রদাহজনিত সমস্যা
পেলভিক প্রদাহজনিত বা পিআইডি একধরনের সংক্রমণ। যা মহিলাদের জননাঙ্গে হয়ে থাকে। এর লক্ষণ হল যোনি থেকে দুর্গন্ধযুক্ত রস ক্ষরণ হয়। এর ফলে অনিয়মিত রজঃস্রাব বা যৌনক্রিয়ার সময় যন্ত্রণাও হয়ে থাকে। যৌনরোগের সংস্পর্শে এল সাধারণত পিআইডি হয়। এর কারণে ফ্যালোপিয়ান টিউবের গুরুতর ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা এবং পরবর্তীকালে গর্ভধারণে সমস্যা দেখা দিতে পারে।
প্রিমেনস্ট্রুয়াল সিনড্রোম
প্রিমেনস্ট্রুয়াল সিনড্রোম হল এমন কিছু লক্ষণ যা রজঃস্রাবের ৭ থেকে ১৪ দিন আগে হয়ে থাকে। এবং কখনও কখনও স্রাব শুরু হওয়ার পর কয়েক দিন থাকতে চলতে থাকে। বহু মহিলাই বিভিন্ন মাত্রায় প্রিমেনস্ট্রুয়াল সিনড্রোমে ভোগেন। রজঃস্রাবের সময়ে কিছু মহিলার প্রবল ব্যথা বা আবেগজনিত সমস্যা দেখা দেয়।
ঋতুস্রাবের সমস্যা নির্ণয়
ঋতুস্রাবের সমস্যা নির্ধারণের জন্য ডাক্তারেরা বেশ কিছু পরীক্ষার পরামর্শ দেন। এর মধ্যে পেলভিক পরীক্ষা, রক্ত পরীক্ষা, আল্ট্রাসাউন্ড উল্লেখযোগ্য। ঋতুস্রাবের সমস্যা যা এক বারই হয়েছে বা অনেক দিন হয়নি, পরবর্তীকালে দীর্ঘ সময় ধরে ঋতুস্রাবের সমস্যা দেখা না দিলেও বয়সের সঙ্গে রেগুলার চেক আপ জরুরি, নয়তো চাপা অবস্থায় রোগ জটিল আকার নিয়ে থাকে।
ঋতুস্রাবের সমস্যার চিকিৎসা
সমস্যার ধরণ এবং কত দিন সমস্যা চলছে তার উপর এই সমস্যার চিকিৎসা নির্ভর করে। তবে ছয় মাস বা তার কম সময় ধরে হলে, কতগুলি বিষয়ে নজর দিতে পারেন।
নিয়মিত ব্যায়াম. সুষম খাদ্য গ্রহণ, আয়রন, ক্যালসিয়াম এবং ভিটামিন যুক্ত খাদ্য গ্রহণ (বা বিকল্প গ্রহণ করা)
স্রাব যন্ত্রণার জন্য প্যারাসিটামল ট্যাবলেট গ্রহণ করা, গরম জলের বোতল ব্যবহার করা, রজঃস্রাব সমস্যার জন্য বিকল্প চিকিৎসার প্রয়োগ করা যেতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে যেমন –
স্রাবের সমস্যার জন্য বিশেষ কোনও ভেষজ ওষুধের প্রয়োগ, রজঃস্রাবের যন্ত্রণার সময় ঔষধি সুগন্ধি গাছ বা তার শুকনো ফুল বা আদার চা খাওয়া, বন্য মিষ্ট আলু বা মাদারওয়র্ট ধরনের এ্যান্টিস্প্যাজমোডিক গ্রহণ করা
পেটে ল্যাভেন্ডারের তেল মালিশ করা, রাস্পবেরি পাতার চা গ্রহণ করা, জিংকগো বিকল্প নেওয়া, স্রাব সমস্যার জন্য বিশেষভাবে তৈরি বচ ফুলের ভেষজ ওষুধ গ্রহণ, মালিশ করানো, আকুপাংচার চিকিৎসা
বেশি রজঃস্রাবজনিত সমস্যা জন্য ডাক্তারবাবু চিকিৎসার জন্য ওষুধের নির্দেশ দিতে পারেন। তার মধ্যে থাকতে পারে:
স্রাবকালীন যন্ত্রণা উপশমে ওষুধ, অনিয়মিত ঋতুস্রাবের সমস্যা দেখা দিলে, হোমিওপ্যাথির অশোকা মাদার টিংচার ৩০ এম এল পরিস্রুত জলে ১৫ ফোঁটা করে দিনে দুবার খেতে হবে ১৫ দিন। অথবা অশোক গাছের ছাল এক গ্লাস জলে ভিজিয়ে সপ্তাহে তিন দিন খেতে হবে।