Breaking News

অস্তিত্বহীন কল্পগল্প নিয়ে ইতিহাসের পাতায় “নাঙ্গেলি’

অর্বিট ডেস্ক প্রায় বছর তিনেক আগে, সোশ্যাল মিডিয়াসহ বিভিন্ন নিউজ পোর্টালে একটি খবর প্রায় দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। সেটি হল, নাঙ্গেলির স্তনকর সংক্রান্ত এক ইতিহাস।

বিষয়টি অনেকেরই জানা, তবু কাহিনি ছোট করে বলে দেওয়া যাক, প্রায় ২০০ বছর আগে, কেরালার ত্রাবাঙ্কুরের রাজা একটি ফরমান জারি করেছিলেন, নীচু জাতের মহিলারা বক্ষ ঢাকতে পারবে না। বক্ষ ঢাকতে হলে তাকে কর দিতে হবে। বক্ষ ঢাকার অধিকার ব্রাহ্মণসহ উঁচু জাতের মহিলাদের রয়েছে।

এমনই স্তন কর আদায়ে রাজার সাগরেদরা যখন নীচু জাতের মহিলাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে পরীক্ষা করে কর আদায় করছে, তখন নাঙ্গেলি নামে এক নীচু জাতের যুবতী সাগরেদদের সামনে নিজের দুটি স্তন কেটে দেয়। তা দেখে রাজার সাগরেদরা পালায়।

কাহিনি এখানেই শেষ নয়, গল্পকে মুখোরোচক করতে আরও আবেদনের মশলাও ছিল। যুবতীদের স্তনের সাইজ ও ওজন বুঝে কর নির্ধারণ হত। আর তা পরীক্ষা করতো রাজার সাগরেদরা।

প্রচীন ভারতের বুকে এমন কাহিনি আধুনিক শিক্ষিত সমাজের পক্ষে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। এবার আসা যাক নাঙ্গেলি কাহিনির আসল ইতিহাসে। ২০১৩ সালে কেরালার এক পেন্টার চিত্রকরণ মুরলি নাঙ্গেলির উত্সর্গ বলে একটি ছবির সিরিজ আঁকলেন। তাঁর দাবি, তিনি ছবিটি এঁকেছে ‘কেরালার কিংবদন্তী লোকগল্প’কে কেন্দ্র করে। মনে রাখবেন, ‘কিংবদন্তী লোকগল্প’। ২০১৬ সালে নাঙ্গেলি ছবি নিয়ে বিবিসি একটি প্রতিবেদন বের করে সঙ্গে চিত্রকরণের সাক্ষাত্কার। ব্যাস তার পরেই সারা বিশ্বে নাঙ্গেলির ইতিহাস নামে ছড়িয়ে পড়ল।

চিত্রকরণ মুরলির আঁকা ছবি ২০১৩ সালে

এবার আসা যাক, ইতিহাসের পোস্টমর্টামে। স্থান সেই কেরালার ত্রাবাঙ্কু। নাঙ্গেলির ঘটনা ঘটেছিল বলে দাবি ২০০ বছ আগে অর্থাত ১৮১৩ সাল বা তার পরে। কিন্তু ইতিহাস বলছে, ত্রাবাঙ্করের সাম্রাজ্য শুরু হয় ১৭২৯ সালে চলে ১৯৪৯ পর্যন্ত।

১৭৮৮ থেকে ১৮০০ পর্যন্ত এই প্রিন্সলে স্টেটের রেসিডেন্ট (এস্টেটের প্রশাসক) ছিলেন জর্জ পাওনি। ১৮০০ থেকে ১৮১০ রেসিডেন্ট ছিলেন কলিন ম্যাকাউলে। ১৮৪০ থেকে ১৮৬০ উইলিয়ম কালেন। ১৯৪৭ সালে ছিলেন কসমো গ্রান্ট নিভেন এডওয়ার্ড। ১৮১১ থেকে ১৮৩৯ পর্যন্ত কোনও ইংরেজ রেসিডেন্ট ছিলেন না। কেন? কারণ রাজপরিবারের সঙ্গে ইংরেজদের সেই সময় কোনও গণ্ডগোল চলছিল।

এবার একটু অন্যদিকে নজর দেওয়া যাক। উনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিক। অবিভক্ত বাংলায় রমরমিয়ে চলছে সতীদাহ প্রথা। এগিয়ে এলেন সমাজসংস্কারক রাজা রামমোহন রায়। লর্ড উইলিয়ম বেন্টিঙের সাহায্যে পাশ হল বেঙ্গল সতী অ্যাবলিশন অ্যাক্ট। মজার ব্যাপার সেই সময়ে দাঁড়িয়ে, ত্রাবাঙ্করের রাজার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে স্তন করের আর তার বিরুদ্ধে ভারতের তাবড় তাবড় সমাজসংস্কারকরা আপত্তি তুললেন না?

ততদিনে ভারতে সংবাদপত্র এসে গিয়েছে। এমনকি ত্রাবাঙ্করে রেসিডেন্টই ছিলেন ইংরেজরা! তাদের কোনও লেখা, রচনা কোথাও নাঙ্গেলির ঘটনা উল্লেখ নেই? এমন অদ্ভুত কাণ্ড কী করে ঘটে ইতিহাসে? এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ইতিহাস থেকেই উধাও এমনকী ব্রিটিশ রেকর্ড থেকেও?

পেন্টার চিত্রকরণ নাঙ্গেলির কাহিনিকে লোকগল্প বলেছেন। লোকগল্প মানে, মানুষের মুখে মুখে ছড়ানো কাহিনি। এটি মুঘল বা তারও আগের ঘটনা হলেও, লোকগল্প হিসেবে বিশ্বাস করা যেত। কিন্তু নাঙ্গেলির কাহিনি ২০১৩ সালের আগে, কোনও লৌকিক গল্প, কাহিনি, মুঘল, ব্রিটিশদের রেকর্ড বা চিঠি, প্রবন্ধে, সেই সময়কার সংবাদপত্রে কোথাও ছাপা হয়নি। কোনও প্রমাণ নেই।

এখন প্রশ্ন ওঠে, ১৮১১ থেকে ১৮৩৯ সাল পর্যন্ত যখন ত্রাবাঙ্কোরে কোনও ইংরেজ রেসিডেন্ট ছিলেন না, তখন কি এস্টেট দখল করার জন্য এমন একটা ভুয়ো অপবাদ রাজার বিরুদ্ধে চালু করেছিল ব্রিটিশরা? উত্তর হল, না, তেমনও কিছু হলে, সাজানো ঘটনা হলেও ইংরেজরা রেকর্ড করতো। ঠিক যেভাবে সিরাজকে সরানোর জন্য কলকাতা ব্ল্যাক হোলের গল্প তৈরি করা হয়েছিল।

অর্থাত ব্রিটিশরাও নাঙ্গেলি গল্পের জন্মদাতা নয়। আসলে এমন কিছু ঘটেইনি। শুধু তাই নয়, এই নবজন্মা কল্পকাহিনিকে ইতিহাসের স্থান দিতে চান্নার বিদ্রোহের সঙ্গেও জুড়ে দেওয়া হয়েছে। যদিও এর কোনও ঐতিহাসিক দলিল এখনও মেলেনি। এবং চিত্রকরণ মুরলি তিনি নিজেও কোনও ঐতিহাসিক লেখা বা প্রমাণ দিতে পারেননি। তিনি দাবি করেছেন, লোকগল্প, কিন্তু তার সূত্রও দিতে পারেননি। যা ২০১৩ সালের আগে কোথাও না কোথাও ছাপা হয়েছে। অর্থাত এটাই প্রমাণ করে ২০১৩ সালের আগে নাঙ্গেলির কোনও ফুটপ্রিন্টই নেই ভারতের ইতিহাস বা লোককথায়।

শুধু তাই নয়, ইন্টারনেটে পাওয়া পুরনো বক্ষখোলা আদিবাসী মহিলাদের ছবি নিয়ে নাঙ্গেলি রিসার্চপেপারও প্রস্তুত হয়েছে অনেক। সে সবই, ২০১৬ সালের পর। প্রমাণ স্বরূপ ব্রিটিশদের তোলা ছবিকেই তুলে ধরা হয়েছে, কিন্তু কোনও ব্রিটিশ রেকর্ডকে উল্লেখ করা হয়নি।

নাঙ্গেলি গল্প নিয়ে বানানো সিনেমার স্থিরচিত্র

এবার আসা যাক, ইন্টারনেটে ঘুরতে থাকা ছবিকে ঘিরে। ভারতে প্রথম স্টিল ক্যামেরা ইংরেজদের হাত ধরে আসে ১৮৫৫ সালে। অর্থাত নাঙ্গেলির ছবি বলে যে খোলা স্তনের ছবি দেখানো হয়, তা ১৮৫৫ সালের পর তোলা। শুধু কেরালা নয়, শ্রীলঙ্কা, তামিলনাড়ুর বহু উপজাতির মহিলারা বক্ষ না ঢেকেই দিনযাপন করতেন। কোনও রাজাদের ফরমান ছাড়াই।

ভারতে এখনও বহু জনজাতি আছে, যাঁদের মহিলারা বক্ষ ঢাকে না। ওডিশা, কেরালা, তামিলনাড়ু, নাগাল্যান্ডে, এখনও রয়েছে।

শ্রীলঙ্গার সিগিরিয়া ফোর্টের ফ্রেস্কো

এবার চলা যাক একটু অতীতের ইতিহাসে। ভারতের প্রচীন কিছু শিল্পকর্ম, চিত্র, সাহিত্য পড়লে দেখা যাবে। একসময় মহিলাদের বক্ষাবরণের সংস্কৃতি ছিলই না। সেটি উঁচু হোক বা নীচু জাত। শ্রীলঙ্কার সিগিরিয়ার ফ্রেস্কো তার বড় উদাহরণ। ভারতের বহু মন্দিরের শিল্পকর্মেও রাজপরিবারের সঙ্গে সংযুক্ত নারীদের ভাস্কর্যে বক্ষাবরণ লক্ষ্য করা যায় না।

সিগিরিয়ার ফোর্টের ফ্রেস্কো

২০১৩ সালে চিত্রকরণ মুরলির নাঙ্গেলি গল্প সামনে আসা। ২০১৬ সালে বিবিসির রিপোর্টের পর, সিবিএসসি বোর্ড নাঙ্গেলির ইতিহাস স্কুল সিলেবাসে চালু করে। ভারতের ১৯ হাজার মনোনীত স্কুলে পড়ানোও শুরু হয়। তারপরেই, এর ঐতিহাসিক ভিত্তি নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। কিন্তু কোনও তথ্যপ্রমাণ না মেলায়, নাঙ্গেলির ইতিহাস স্কুল পাঠ্যসূচি থেকে সরানো হয়।

আমাদের চ্যানেলে যুক্ত হয়ে যান

About Orbit News

Check Also

উত্তরাখণ্ডের পঞ্চ বদ্রি: ভগবান বিষ্ণুর পবিত্র পাঁচ ধাম

উত্তরাখণ্ডের হিমালয়ের কোল জুড়ে ছড়িয়ে থাকা পাঁচটি পবিত্র বদ্রি মন্দির – বদ্রীনাথ, যোগধ্যন বদ্রি, ভবিষ্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!