প্রাচীন ভারতীয় সনাতন ধর্মে মূল তিনটি দেবতাকে প্রধান হিসেবে ধরা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে অন্যতম শিব বা মহাদেব। শিবপুরাণ মতে, তিনিই দেবাদিদেব মহাদেব। অর্থাৎ সমস্ত দেবতার দেবতা। মহাদেবের আশির্বাদ পেতে শিব ভক্তরা নিয়মিত উপাসনা করে থাকেন। যদিও শ্রাবণ মাসে সারা ভারতে বিভিন্ন কোনায় মহাদেবকে ঘিরে উৎসব, পার্বণ চলে।
ভারতের মহাদেবের ১২টি জ্যোতির্লিঙ্গ রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম ত্রিম্ব্যকেশ্বর বা ত্র্যম্বকেশ্বর। কিংবদন্তী রয়েছে, কালসর্প দোষ কাটানোর জন্য বহু ভক্ত এই মন্দিরে আসেন। মন্দিরের ভিতর ছোট তিন শিবলিঙ্গ রয়েছে। এটি স্বয়ম্ভু লিঙ্গ হলেও, তিনটি অংশ দেখা যায়। এর বিশেষত্ব হল, এই তিন অংশ আসলে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরের প্রতীক। ১২টি জ্যোতির্লিঙ্গের মধ্যে একমাত্র ত্র্যম্বকেশ্বরের তিন দেবতা একসঙ্গে পুজো করা হয়ে থাকে।
মহারাষ্ট্রের নাসিকে পাশাপাশি তিনটি পাহাড় রয়েছে ব্রহ্মগিরি, গঙ্গাধার এবং নীলগিরি। ব্রহ্মগিরিকে মহাদেবের প্রতিরূপ মনে করা হয়। পাশেই নীলগিরি পর্বতে লীলাম্ভিকা দেবী ও দত্তাত্রেয় গুরুর মন্দির রয়েছে।
ত্রিম্বকেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দিরের পুরাণকথা?
পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে, ব্রহ্মগিরি পাহাড়ে বাস করতেন ঋষি গৌতম এবং তাঁর স্ত্রী অহল্যা। দুজনে উপাসনা ও চাষাবাদের উপর জীবনযাপন করতেন। এঁদের প্রতি হিংসা করতেন অন্যান্য তপস্বীরা। একবার, ঋষি গৌতমের ক্ষেতে, অন্য তপস্বীরা একটি গরুকে পাঠিয়ে দেয়। যাতে ফসলের ক্ষতি হয়। ক্ষেত থেকে সরানোর জন্য ঋষি গৌতম গরুটিকে তাড়া করেন, কিন্তু গরুটি পালাতে গিয়ে কোনও কারণে মারা যায়। এরপরেই অন্য তপস্বীরা, ঋষি গৌতমের উপর গো হত্যার অভিযোগ আনে। এবং নিদেন দেন, প্রায়শ্চিত্ত করতে গেলে গঙ্গাকে এখানে আনতে হবে।
দশচক্রে পড়ে ঋষি গৌতম মহাদেবের উপাসনা শুরু করেন। দেবী পার্বতী এবং মহাদেব গৌতমের উপাসনায় প্রসন্ন হয়ে দেখা দেন। ঋষি গৌতমের আবেদন মতো মহাদেব বর দিলেন, অন্যদিকে দেবী গঙ্গা জানালেন, যদি এখানে মহাদেব স্বয়ং বাস করেন, তবেই তিনি এখানে প্রকট হবেন। দেবীর ইচ্ছানুসারে মহাদেব এখানে জ্যোতির্লিঙ্গ রূপে উপবিষ্ঠ হলেন। দেবী গঙ্গা এখানে গৌতমী রূপে প্রবাহিত, এখানে তাঁর আর এক নাম গোদাবরীও।
পুরাণকথা অনুসারে এই মন্দিরকে কেন্দ্র করে আরও কয়েকটি জনপ্রিয় কাহিনি রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম, একবার ওখানকার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। প্রায় ২৪ বছর কোনও বৃষ্টিপাত হয়নি। ক্ষুধার অভাবে বহু মানুষ ও প্রাণী মারা পড়তে থাকে। এই পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে বরুণের উপাসনা করেন ঋষি গৌতম। তার পর থেকে তাঁর আশ্রমে বৃষ্টিদান শুরু করেন বরুণ।
ত্রিম্বকেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দিরের ইতিহাস
কিংবদন্তী রয়েছে, প্রচীন কাল থেকেই এখানে মহাদেবের মন্দির রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে যে মন্দিরটি দেখা যায়, ১৭৪০-৬০ সালে এটি তৈরি করিয়েছিলেন তৃতীয় পেশোয়া বাজীরাও। পুরো মন্দিরটি কালো পাথরে নির্মাণ করা হয়েছে। এর স্থাপত্যও অসাধারণ। ইতিহাস বলছে, এই মন্দির নির্মাণে সেই সময় খরচ পড়েছিল ১৬ লক্ষ টাকা।
এই মন্দিরের সংরক্ষণ ও পরিচালনা করে থাকেন ত্র্যম্বকেশ্বর টেম্পল ট্রাস্ট। পাশেই দর্শনার্থীদের জন্য তৈরি করা হয়েছে শিবপ্রসাদ ভক্ত নিবাস, এখানে মোট ২৪টি রুম রয়েছে (২ বেড, ৩ বেড, ৫ বেডের)।
ত্র্যম্বকেশ্বর মন্দিরে পুজো কখ হয়?
ভোর ৫.৩০ থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত চলে মঙ্গল আরতি
সকাল ৬টা থেকে ৭টা পর্যন্ত চলে অন্তরালয় অভিষেক
সকাল ৭টা থেকে ৯টা পর্যন্ত চলে মহামৃত্যুঞ্জয় পুজো
দুপুর ১টা থেকে ১.৩০ মিনিট পর্যন্ত হয় মধ্যাহ্ন পুজো
সন্ধে ৭টা থেকে ৯টা পর্যন্ত সান্ধ্য পুজো
এটি ভারতের একমাত্র মন্দির যেখানে কালসর্প দোষ কাটানোর জন্য দেশ বিদেশ থেকে বহু পুণার্থী আসেন এখানে।
এই মন্দিরে এখনও নিয়মিত ঋক, সাম, যজু, অথর্ব বেদ পাঠ করা হয়।
ত্র্যম্বকেশ্বর মন্দিরে কীভাবে যাবেন?
হাওড়া থেকে মুম্বরগামী মেল এক্সপ্রেস ধরে নামতে হবে নাসিকরোড স্টেশনে। এখান থেকে গাড়ি ভাড়া করে যেতে পারেন বা বাসও যাচ্ছে। ত্র্যম্বকেশ্বর মন্দিরের কাছে অনেক হোটেল রয়েছে, সেখানেও থাকতে পারেন আর এই মন্দির ছাড়া নাসিক ও অন্যান্য জায়গা দেখতে হলে নাসিকে থাকাই ভালো।
নাসিকে আর কী কী দেখার আছে?
নাসিক হল পৌরাণিক গাথায় তপোবন অঞ্চল, রামায়ণের বনপর্ব এই জায়কে ঘিরে। ফলে, বনবাসপর্বে রামসীতা যেখানে থাকতেন এবং যেখান থেকে রাবণ সীতা মাকে অপহরণ করেছিল, সেই জায়গাগুলিও দেখে নিতে পারবেন।
এক যাত্রায় দেখা নিতে পারেন, শ্রীনিলম্বিকা দত্তাত্রেয় মাতম্বা মন্দির, কালারাম মন্দির, পাণ্ডবলেনী গুহা, মুক্তিধাম মন্দির, দুধসাগর ঝরনা, তপোবন ইত্যাদি।
বিশেষ সতর্কতা– ভারতের অধিকাংশ ধর্মস্থলেই চোর, ছিন্তাইবাজ, ঠগবাজ রয়েছে। তাই রাতের দিকে নাসিক রোড স্টেশনে নামলে, স্টেশনে থাকার চেষ্টা করুন, নয়তো স্টেশনের কাছে হোটেলে থাকার ব্যবস্থা করুন। সরাসরি ত্র্যম্বকেশ্বর মন্দির আসার প্রয়োজন নেই। আর নাসিক ত্র্যম্বকেশ্বর মন্দির, শিরডি, অজন্তা ইলোরা, ঘৃষ্ণেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গসহ একাধিক স্থান বেড়ানোর পরিকল্পনা করলে সরাসরি যোগাযোগ করতে পারেন 9073503958 নম্বরে।
FAQ
Qত্র্যম্বকেশ্বর মন্দির কোথায়?
ত্র্যম্বকেশ্বর মন্দির নাসিকে
Qত্র্যম্বকেশ্বর মন্দির কত পুরনো?
এই মন্দির বহু পুরনো। এই মন্দিরের পুনর্নিমাণ করান তৃতীয় পেশোয়া বালাজী বাজিরাও (১৭৪০-১৭৬০) খ্রিস্টাব্দে
Q ত্র্যম্বকেশ্বর মন্দির কে নির্মাণ করেছিলেন?
এই মন্দির পুনর্নিমাণ করিয়েছিলেন তৃতীয় পেশোয়া বালাজী বাজিরাও।
Q ত্র্যম্বকেশ্বর মন্দিরের বিশেষত্ব কি?
এই মন্দিরের বিশেষত্ব শিবলিঙ্গে। এখানে রয়েছেন ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর।
Q নাসিকে কী কী মন্দির রয়েছে?
কালারাম মন্দির, রামকুণ্ড, সীতা গুহা, সপ্তশৃঙ্গীদেবী মন্দির
Q নাসিকে কটি জ্যোতির্লিঙ্গ রয়েছে?
নাসিকে ১২টি জ্যোতির্লিঙ্গের মধ্যে একটি অবস্থিত
Q ত্র্যম্বকেশ্বর কেন প্রসিদ্ধ?
ত্র্যম্বকেশ্বর ভারতের সবচেয়ে পবিত্র তীর্থক্ষেত্র মনে করা হয়, এবং ভগবান গণেশের জন্মস্থল।
Q ত্র্যম্বকেশ্বর মন্দিরের কাহিনি কি?
ত্র্যম্বকেশ্বর মন্দিরের জ্যোতির্লিঙ্গের সঙ্গে জুড়ে রয়েছে ঋষি গৌতম ও গঙ্গা নদীর কাহিনি
Q ত্র্যম্বকেশ্বর মন্দিরের পাশে কী নদী রয়েছে?
গৌতমী বা গোদাবরী