অর্বিট ডেস্ক– ঘটনার সূত্রপাত, যোগী আদিত্যানাথের বক্তব্যকে ঘিরে। রবিবার লখনউতে সামাজিক প্রতিনিধি সম্মেলনে গিয়ে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যানাথ বলেছেন, মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত আলেকজান্ডারকে হারিয়েছিলেন। অথচ আমাদের ভারতের ইতিহাসে বারবার পড়ানো হয়েছে, আলেকজান্ডার মহান।
এই বক্তব্যটি প্রকাশ্যে আসার পরেই, ভারতের মেনট স্ট্রিম সংবাদমাধ্যমের একাংশ ঝাঁপিয়েছে পড়েছেন, তথ্য বিকৃতির অভিযোগ এনে। দাবি করা হয়েছে, যোগী আদিত্যনাথ, অমিত শাহেরা ইতিহাস গুলিয়ে দিচ্ছেন। ভুল ইতিহাস চাপাচ্ছেন সাধারণের মনে।
বিজেপি বিরোধীরাও পুনরায় যুদ্ধংদেহী মনোভাব নিয়ে বাপবাপান্ত করতে লেগেছেন। আনন্দবাজার পত্রিকা দাবি করেছে, আলেকজান্ডার যখন ভারতে আসে, তখন চন্দ্রগুপ্ত নাবালক। তাই চন্দ্রগুপ্তের সঙ্গে যুদ্ধের কোনও ঘটনা ঘটেনি।
বিষয়টি নিয়ে আনন্দবাজার পত্রিকা কটাক্ষ করলেও, কোনও ইতিহাসবিদের কোট ব্যবহার করেননি, বরং সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়াকে আধার করে নিজেদের মতামত পোষণ করেছেন খবরে। আননন্দবাজার দাবি করেছেন, যোগীর এই তথ্য জানার পর, ইতিহাস পড়ুয়া থেকে গবেষকেরা চমকে গিয়েছে।
অর্থাত আনন্দবাজার পত্রিকা যা বোঝাতে চেয়েছে, ভারতে ইতিহাস বিকৃতি নিয়ে একটা মারাত্মক ষড়যন্ত্র চলছে। এবার আসা যাক আসল তথ্যে।
মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত রাজা ধনানন্দকে হারিয়ে মৌর্য সাম্রাজ্য স্থাপন করেন ৩২৪ থেকে ৩২১ খ্রিস্ট পূর্বাব্দের মধ্যে। (গবেষকদের ধারণা) তিনি রাজত্ব করেন ২৯৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত। অধিক গবেষকদের মনে করেন মৌর্য সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা পায় ৩২২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। আর আলেকজান্ডার ভারতে আসেন ৩২৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। (হাইডাসপাসের যুদ্ধ পুরু সঙ্গে) ৩২৩ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে আলেকজান্ডার মারা যান।
অর্থাত, বর্তমানের প্রতিষ্ঠিত ইতিহাসের সূত্র ধরলে মৌর্য সাম্রাজ্য স্থাপনের দু বছর আগে আলেকজান্ডার ভারতে আসেন। রাজা পুরুর সঙ্গে যুদ্ধ হয়। যদিও সবার জানা, ভারত স্বাধীন হয়, ১৯৪৭ সালে তারপর কংগ্রেস আমলে আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য ইতিহাস রচনা শুরু করেন।
ভারত স্বাধীন হওয়ার আগে বিখ্যাত নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। সারা বিশ্ব যাঁকে চেনেন ডি এল রায় নামে, তিনি একাধিক ঐতিহাসিক নাটক রচনা করেন। তার মধ্যে একটি চন্দ্রগুপ্ত। সময়টা ১৯১১ সাল, অর্থাত দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে।

তাঁর নাটকটি কাল্পনিক হলেও, তিনি ভূমিকাতে স্বীকার করেন, চন্দ্রগুপ্ত সম্পর্কিত যতটা ভারতীয় পৌরাণিক ও গ্রিক ইতিহাস পেয়েছেন, তা নাটকে দিয়েছেন। ডি এল রায় ইংরেজ আমলে ডেপুটি মেজিস্ট্রট ছিলেন, লন্ডনেও পড়াশুনা করেন। তাঁর চন্দ্রগুপ্ত নাটকের ঘটনাপ্রবাহ পড়লেই বোঝা যায়। সেখানে বলা হচ্ছে, সিকন্দর সাহের সঙ্গে (আলেকজান্ডার) চন্দ্রগুপ্তের দেখা হয়েছিল, তখন অবশ্য চন্দ্রগুপ্ত রাজা হননি।

আলেকজান্ডারের প্রধান সেনাপতি ছিলেন সেলুকাস, পরে তিনি গ্রিক সম্রাট হন। চন্দ্রগুপ্ত নাটকে তার একটি সংলাপ বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তৃতীয় অঙ্কের চতুর্থ দৃশ্যে, যেখানে সেলুকাস বলছে, এবার সেকন্দর সাহের দিগ্বিজয় সম্পূর্ণ করবো। চন্দ্রগুপ্ত, এক বছরে তুমি ভারতে গ্রিক উপনিবেশ নির্মুল করেছো, এবার তার শোধ দেব।
অর্থাত, চন্দ্রগুপ্ত গ্রিকদের যে তাড়িয়েছিল, তার সূত্র রয়েছে। চন্দ্রগুপ্ত নাটকের ভূমিকায় ডি এল রায় অবশ্য স্বীকার করেছেন, চন্দ্রগুপ্ত সম্পর্কে খুব বেশি ঐতিহাসিক তথ্য নেই। সেক্ষেত্রে, পৌরাণিক কাহিনি, পৌরাণিক নাটক, বৌদ্ধধর্মের কাহিনি থেকে নেওয়া।
তবে নাটকে সেলুকাসের সঙ্গে যুদ্ধ ও হেলেনের সঙ্গে সম্পর্কের কথা ভারতীয় পৌরাণিক কাহিনি নাটকে নেই। সেটি ডি এল রায় নিয়েছেন, গ্রিক ইতিহাসে।
অতএব ইতিহাস নিয়ে দ্বন্দ্ব যাই থাকুক, ছেঁড়াফাটা সূত্র ধরেই বলা চন্দ্রগুপ্তের রাজত্ব কালেই আলেকজান্ডারের সেনাকে বিপাকে পড়তে হয়েছিল, আর সেই ক্ষত, সেলুকাসের স্মৃতিতে ছিল। সিদ্ধান্তে যদি আসা যায়, তাহলে বলা যেতে পারে, প্রাচীন ভারতের ইতিহাস ও সময়কাল নিয়ে পুরোপুরি প্রামাণ্য তথ্য কারও কাছেই নেই।
তবে সূত্র বলতে পৌরাণিক কাহিনি, নাটক, ইতিহাসমূলক কাব্য, স্থাপত্য, ভাস্কর্য, শিলালেখ ইত্যাদি। সেগুলি ভিন্ন ইতিবাস বিদ, ভিন্ন রকম সিদ্ধান্তে পৌঁছন। অনেকে পৌরাণিক নাটক বা কাহিনিকে ইতিহাসের সূত্র বলেই মানতে চান না।