স্বাতী চ্যাটার্জি– আপনাদের মহাভারতের খান্ডবন দহনের কথা মনে আছে? আছে হয়তো, তবু ছোট করে কয়েকটি লাইনে বলি। পান্ডবদের নগর তৈরির জন্য, যে জমি দেওয়া হয়েছিল, সেটি খান্ডব বন। সেই মহারণ্যকে পুড়িয়ে তৈরি করা হয়েছিল ইন্দ্রপ্রস্থ নগর।
খান্ডব বন দহনে, বহু, পশু পাখি, সরিসৃপের মৃত্যু ঘটেছিল। তার থেকে জন্ম নিয়েছিল এক অভিশাপ। আর সেই অভিশাপের থেকে জন্ম নিয়েছিল, হিংসার পাল্টা প্রতিহিংসা। আর এই হিংসা ও প্রতিহিংসার বৃত্তেই গড়িয়েছিল, মহাভারতের মতো মহাকাব্যের ঘটনা পরম্পরা। তার মধ্যে এসেছে, নানা চরিত্র, জাতি, বর্ণ, ধর্ম, অধর্ম, যুদ্ধ, শান্তি সর্বপরি গোটা ব্রাহ্মাণ্ডের সার্বিক অভিব্যক্তি।
এবার আসা যাক মণিপুরে। মণিপুরের কথা রয়েছে মহাভারতেও, এখানকার এক কন্যাকে বিয়ে করেছিলেন অর্জুন। নাম চিত্রাঙ্গদা। তাঁদের সন্তান এই মণিপুরের রাজা হয়েছিলেন, নাম বব্রুবাহন। অর্থাৎ মহাভারত যখন লেখা হয়েছিল, তখনও ছিল মণিপুর। সেখানে রাজাও ছিল, রাজত্ব ছিল। অর্থাৎ, মণিপুরের ইতিহাস দু পাঁচশো বছরের নয়।
এবার যে পর্বে ঢুকবো, তা আধুনিক সময়ে। যার ইতিহাস গত দু মাসে হাজার হাজার কন্টেন্টে ইতিমধ্যেই পেয়ে গিয়েছেন। কিন্তু কতগুলি মূল প্রশ্ন, যেগুলি তোলা হচ্ছে না, বা হয়তো আগামী দিনেও হবে না। হলে হয়তো সমস্যার সমাধান হবে। সেগুলির দিকে নজর দেওয়া হচ্ছে না।
আপনারা ইতিমধ্যে জেনে গিয়েছেন, মণিপুরে বর্তমানে যে গণ্ডগোলটি চলছে, তা হল, দুটি সম্প্রদায়ের লড়াই। এক মেইতেই এবং দুই কুকি। আপনারা এটাও জেনে গিয়েছেন, কুকি আসলে উপজাতি, এবং ধর্মে খ্রিস্টান। (এটা মনে রাখুন খ্রিস্টান) যাঁরা মণিপুরের পাহাড়ি অঞ্চলে প্রায় ৮০ শতাংশ অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। আর মেইতেই জাতি মূলত ইম্ফল ও তার আশে পাশে থাকে। সর্বপরি মেইতেই হিন্দু সম্প্রদায়ের।
হালের মূল দ্বন্দ্ব কোথায়? উত্তর হল, মেইতেই জাতির নাগরিকরা দাবি জানিয়ে আসছিল, তাঁদেরও তফশিলী উপজাতির তকমা দিতে হবে। কেন? কারণ, তাঁরা উপজাতি তকমা না পাওয়ার ফলে, রাজ্যে সমস্ত রিসোর্সে সম্পূর্ণ অধিকার পাচ্ছিলেন না। যেমন কারও মনে হল, পাহাড়ি এলাকায় জমি কিনে কিছু একটা করবেন, চাষবাস বা ট্যুরিজিমের হোমস্টে ব্যবসা ইত্যদি। কিন্তু তাঁরা সেই সুযোগ পান না।
কারণ ওই সব অঞ্চল উপজাতিদের জন্য বরাদ্দ। তাঁরা বাইরের কাউকে জমি বিক্রি করতে পারবেন না। তার মধ্যে মেইতেইও পড়ে। এই বৈষম্য দূর করতেই তাঁদের দাবি, তাঁদেরও উপজাতি হিসেবে তকমা দেওয়া হোক। এখানেই আপত্তি কুকিদের। তাঁদের দাবি, এমনিতেই মেইতেইরা উঁচু জাতি, অনেক সুখ সুবিধা পেয়ে এসেছে। তাহলেও ওদের দেওয়া কেন? সাফ কথা বাড়তি অধিকার দেওয়া যাবে না।
এদিকে মণিপুর হাইকোর্ট একটি রায় দেয়, মেইতেইদেরও তফশিলী উপজাতি হিসেবে তকমা দিতে পারবে সরকার। এরপরেই দ্বন্দ্ব শুরু। কুকিদের দাবি, মেইতেইরা যে সুবিধা পেয়েছ, তারপরেও যদি তাঁদের উপজাতি হিসেবে তকমা দেওয়া হয়, তাহলে, তাদের জন্য বরাদ্দা কোটায় ভাগ বসাবে মেইতেইরা। ফলে তাদের দুর্দশা আরও বাড়বে। আপনারা এই পর্যন্ত গল্প জেনেই গেছেন। তাই এই বিষয়ে আর বিস্তারিত কিছুতে যাচ্ছি না।
এবার আসা যাক কয়েনের উল্টো পীঠে। আর সেখানেই লুকিয়ে রয়েছে বহু প্রশ্ন এবং সমাধানের উত্তর। প্রশ্ন হল, মণিপুরে ২৫ শতাংশ কুকি জনজাতি, ১৫ শতাংশ নাগা উপজাতি। বাকি ৬০ শতাংশ মেইতেই উপজাতি। বিষয়টা কেমন গোলমেলে ঠেকছে না? ২৫ শতাংশ কুকি জনজাতি, থাকে মণিপুরের ৮০ শতাংশ জায়গা জুড়ে! এবং তাঁরা অধিকাংশই ধর্মে খ্রিস্টান! কেন? এবং কীভাবে?
আসলে ইংরেজরা ভারতের পা রাখার পরেই বহু জায়গায় ধর্মান্তকরণ করেছিল। মণিপুরও বাদ যায়নি। তাই পাহাড়ি বা অরণ্য অঞ্চলে পিছিয়ে পড়া এলাকাতেই তারা গরিব গুর্বো জনজাতিদের প্রথম টার্গেট করে ধর্মান্তকরণের জন্য। কারণ প্রাকৃতিক রিসোর্সকে ব্যবহার করতে গেলে, এটাই প্রধান অস্ত্র। আর এখানেই নাগা ও কুকিসহ বেশ কিছু উপজাতি দ্রুত ধর্মান্তকরণে পা দেয়।
মজার বিষয় হল, এদের ধর্মান্তকরণতো করা হল, কিন্তু প্রশাসনিক কাজে এদের ব্যবহার প্রায় করাই হত না। ফলে তিনশো বছর পরেই এই উপজাতিগুলি, ধর্মের নেশায় মজেই রইল। আর দেশ স্বাধীন হওয়ার পর, সেই নেশা আরও ধরিয়ে দেওয়া হল, সংরক্ষণ নামক এক অদ্ভুদ সোনার পাথর বাটি দিয়ে।
তাহলে প্রশ্ন আসে, কুকি. নাগাদের ধর্মান্তকরণ করা হল, অথচ তাদের প্রশাসনিক উচ্চপদে কেন নিত না ইংরেজরা? উত্তর হল, জল, জঙ্গল, পাহাড়ের রিসোর্সকে যাতে নির্ঝঞ্ঝাট ভাবে ব্যবহার করা যায়, এবং এদের দিয়ে যাতে এমন কাজ করিয়ে নেওয়া যায়, যাতে আখেরে ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদীদেরই সুবিধা হয়। হ্যাঁ এদের দিয়েই, চাষ করানো হত পোস্ত, আফিম। সেই ইতিহাসের ধারা এখনও চলছে। আর দ্বন্দ্ব এখানে।
বর্তমান সরকার চেয়েছিল, এক সঙ্গে দুটি বান মারতে, এক পাহাড়ি অঞ্চলে বেআইনি পোস্ত, আফিম চাষ বন্ধ করা। এটি করলে, মণিপুর, নাগাল্যান্ড, মিজোরামে যে পরিমাণ সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী রয়েছে, তাদের আয়ের রাস্তা বন্ধ হয়ে যাবে। দ্বিতীয় বিষয় হলে, মেইতেইদের তফশিলী তকমা দিলে, তারাও মণিপুরের যে কোনও জায়গায় জমি কেনা, বা উন্নয়নে অংশ নিতে পারবে।
আর এই খেলাতেই আপত্তি, কিছু গোষ্ঠী, সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী, দেশের কিছু রাজনৈতিক গোষ্ঠী অবশেষে দুটি পড়শিদেশের। লিখিত ইতিহাস বলছে, মণিপুরে সবচেয়ে প্রাচীন জনগোষ্ঠী হল মেইতেই। মহাভারতের সূত্র ধরলে, এদের সংস্কৃতির ইতিহাস কমপক্ষে সাড়ে চারহাজার বছরের পুরনো। আর লিখিত রেকর্ডেড ইতিহাস দেখলে আড়াই হাজার বছরের। অন্যদিকে, কুকি সম্প্রদায় পুরোটাই এসেছে মায়ানমার থেকে। চারশো বছরও হয়নি।
এবার আসি আরও গভীরে কিছু প্রশ্নে, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর, পশ্চিম, পূর্ব, দক্ষিণ এমনকী মধ্য ও উত্তরভারত যতটা সুযোগ সুবিধা পেয়েছ, উত্তরপূর্ব ভারতের রাজ্যগুলি ততটা উন্নত নয় কেন? বলা ভালো হয়নি কেন? উত্তর হল, সেই কলোনিয়ান হ্যাংওভার, ব্রিটিশদের দেখানো রাস্তা। উত্তরপূর্ব ভরতের ত্রিপুরা, অসমের কিছুটা উন্নতি হয়েছিল, ইংরেজদের প্রশাসনিক কেন্দ্র যেহেতু ছিল, অবিভক্ত বাংলা, রাজধানী ছিল কলকাতা ব্যাস এই টুকুই। যেহেতু তৎকালীন বার্মাতেও তাদের উপনিবেশ ছিল।
কিন্তু, অধুনা অরুণাচল, নাগাল্যান্ড, মণিপুর, মিজোরামে ব্যাপক ধর্মান্তকরণ হয়েছে, আফিম চাষ আর দুই বিশ্বযুদ্ধে সেনানিয়োগ ছাড়া আর কোনও উন্নতি করেনি। স্বাধীনতার পরেও, উত্তরপূর্ব ভারতের রাজ্যগুলি নিয়ে তেমন কোনও প্রধানমন্ত্রী বা সরকার কেউই কিছু করেনি। ফলে ব্রিটিশদের দেওয়া পেশা মাদক চাষ আর সন্ত্রাসবাদের চাষ হয়েছে।
এখন প্রশ্ন, কেন কোনও সরকার কিছু করল না উত্তরপূর্ব রাজ্যগুলিতে? ভয়, ১৯৬৫ সালে চিনের কাছে হেরে যাওয়ার পর, চূড়ান্ত ভয়। বিপুল অঙ্কের টাকা খরচ করে উত্তর পূর্ব ভারতে রেল ও সড়ক যোগাযোগ করা হলে, চিন যদি আক্রমণ চালায়!, তাহলে ভারতের পরিকাঠামো ব্যবহার করে চিন সেনা পুরো উত্তরপূর্ব দখল করে, পূর্বের রাজ্যগুলিকেও দখল করে নিতে পারে।
ফলে, চট্টগ্রাম, কলকাতা বন্দর চলে যাওয়া মানে বঙ্গোপসাগর হাতছাড়া হওয়া, আন্দামান নিকোবরও তাই। ফলে, মরুককে যাক উত্তরপূর্ব ভারত। তাই স্বাধীনতার পর থেকেই উত্তরপূর্ব ভারতের রাজ্যগুলি বিধ্বস্ত হয়েছে সন্ত্রাসবাদী দ্বারা। তাদের মধ্যে অধিকাংশ গোষ্ঠী কয়েক দশক ধরে ব্ল্যাকমেল করে আয় করে গেছে, আর নিজেদের গোষ্ঠীর লোকেদের স্বাধীন রাষ্ট্রের অজুহাত দেখিয়ে ব্যবহার করে গেছে।
আমি শুধু ইতিহাসের সূত্র ধরে সংক্ষেপে ফ্যাক্ট বললাম। আবার আপনাদের কাছে প্রশ্ন।
১) ৮০ শতাংশ পাহাড়ি অঞ্চলে মাদক চাষ চলতে দেওয়া উচিৎ, যার অধিকাংশ আয় চলে যায় সন্ত্রাসবাদীদের হাতে। রাজ্যের কোনও উন্নয়নতো হয় না। আর সরকারের তরফে কোনও শিল্প, উন্নয়ন করতে গেলে, চলে অপহরণ ও তোলাবাজি, খুন।
২) দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কুকি সম্প্রদায়ের লোকেরা সংরক্ষণ পাওয়ার পরেও, দেশের মেন স্ট্রিম পড়াশুনা এবং সরকারি চাকরি বা কোনও উন্নয়নে কেন আসতে চায় না? সংরক্ষণ শুধু কি নিজেদের জমিকে আঁকড়ে রাখা এবং সেখানে বেআইনি আফিম চাষ চালিয়ে যাওয়ার জন্য?
না স্বাধীনতার পর তখনকার সরকাররা কিছুই করেনি, এটা বললে ভুল হবে, ব্ল্যাকমেল সহ্য করতে না পেরে, আর্মড ফোর্সেস স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট লাগু করেছিলেন। মনে আছে নিশ্চয়ই, ২০০৪ সালের সেই বিখ্যাত ছবি! ইন্ডিয়ান আর্মি রেপ আস। একদল নগ্ন মহিলা প্রকাশ্য রাস্তায় নেমে পড়েছিলেন একটি ব্যানার নিয়ে। দেশের কিছু ক্ষুদ্র ও অতিক্ষুদ্র মানসিকতার রাজনৈতিক দলগুলি চেঁচামেচি শুরু করেছিল, দেখুন ভারতীয় সেনা কী জিনিস। মাত্র উনিশ বছর আগের ঘটনা মাত্র।
না, এখন মণিপুরে আর্মড ফোর্সেস স্পেশার পাওয়ার অ্যাক্ট লাগু হয়নি। এখনও লাগু করেনি সরকার। তাই আপনাদের বলছি, মণিপুরে আর্মড ফোর্সেস স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট ও তার ইতিহাস পড়ে নেবেন। তাহলে, বর্তমান সময় কতটা গরম, কতটা নরম আর কীভাবে মণিপুরের সমস্যা সমাধান হওয়া উচিৎ তার রাস্তা মিলবে।