অর্বিট ডেস্ক-প্রতিবেশি রাজ্য সিকিম তার প্রকৃতিক ডালি সাজিয়ে আছে ভিন্ন রূপে। সেই কারণে বাঙালিদের কাছে অত্যন্ত প্রিয় জায়গা সিকিম। সিকিম কীভাবে বেড়াবেন? তারই খুটিনাটি নিয়ে অর্বিট নিউজের বিস্তরিত ভ্রমণ প্রতিবেদন।
ভ্রমণ পর্বে যাওয়ার আগে সিকিমের সম্পর্কে একটু জেনে নেওয়া যাক। ১৯৭৫ সালের ২৬ এপ্রিল সিকিম বারতের ২২তম অঙ্গরাজ্যে পরিণত হয়। পূর্বে ভুটান, পশ্চিমে নেপাল ও উত্তরে তিব্বত। বিশ্বের তৃতীয় উচ্চতম শৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘা, সিনিয়লচু, সিম্ভো, পান্ডিম, কাবরু, নরসিংহ প্রভৃতি শৃঙ্গের শোভা যেমন আমাদের আপ্লুত করে, তেমন প্রাচীন রুমটেক, পেমিয়াংশি, রালং প্রভৃতি গুম্ফা সিকিমের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে তুলে ধরে।
তিস্তা এবং রঙ্গিত এই দুই নদী সিকিমের মধ্যে দিয়ে বয়ে গিয়েছে। সিকিমকে আরও একটি নামে ডাকা হয়, তা হল ল্যান্ড অফ অর্কিড।অসংখ্য রং ও আকৃতির অর্কিডের দেখা এখানে মেলে। সরকারি পরিসংখ্যান বলছে ৬৫০ প্রজাতির অর্কিড রয়েছে সিকিমে। এছাড়া ৫৫০ রকমের প্রজাতির পাখির বাসভূমি সিকিমে। রোডোডেন্ড্রনের শোভা দেখতে হলে আপনাকে যেতেই হবে সিকিমে।
গ্যাংটক-ইয়ুমথাং-গুরুদোংমার
সিকিমের রাজধানী গ্যাংটক। উচ্চতা ৫৫০০ ফুট। নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে ১২৫ কিমি দূরে রয়েছে এই শহর। গ্যাংটক শহর এবং আশেপাশের জায়গাগুলি গাড়ি ভাড়া করে দেখে নেওয়া যেতে পারে। শহরের মধ্যে আছে এনচে মনাস্ট্রি। প্রত্যেক বছর জানুয়ারিতে এখানে ধর্মীয় মুকোশনৃত্য ছাম অনুষ্ঠিত হয়। শহর থেকে ২৪ কিমি দূরে রয়েছে রুমটেক গুম্ফা। এটি সিকিমের সবচেয়ে জনপ্রিয় বড় গুম্ফা। ১৭১৭ সালে এই গুম্ফা তৈরি হয়। এখানে তিব্বতীয় বৈদ্ধধর্মের বিভিন্ন গাথা ম্যুরালের মাধ্যমে ধরা রয়েছে। একই পথে দেখে নেওয়া যায় রাংকা গুম্ফা ও তিনতালে। একে একে দেখে নিন চোগিয়াল রাজাদের রাজবাড়ি, ইনস্টিটিউট অফ টিবেটোলজি, অর্কিড হাউস, ডিয়ার পার্ক, বটানিক্যাল গার্ডেন। তাশি ভিউ পয়েন্ট, হনুমান টক, গণেশ টক থেকে কা়্চনজঙ্ঘা ও সিনিয়লচু শৃঙ্গের অসাদারণ শোভা দেখা যায়।
ভ্রমণের খবরে আপডেট থাকতে জুড়ে যান আমাদের ট্রেলিগ্রাম চ্যানেলে
গ্যংটক থেকে ২৫ কিমি দূরে ফ্য়ামবং-লো অভয়ারণ্য ঘুরে নিতে পারেন। এখানে যেতে হলে, ২ কিমি জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হয়। রেড পান্ডা, বার্কিং ডিয়ার, ভালুক, মোনাল প্রভৃতির দর্শন মেলে। গ্যাংটকের সবচেয়ে জনপ্রিয় প্যাকেজ ট্যুর হল ইয়ুমথাং সফর। দূরত্ব ১৪০ কিমি। সকাল সকাল গাড়িতে বেরিয়ে ফোদং, মংগন পেরিয়ে পথে পড়বে সিংঘিক। এই সিংঘিক থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা সবচেয়ে কাছে দেখা যায়। সিংঘিক পেরোলে চুংথাং। এখানে লাচুং চু ও লাচেন চু দুটি নদী এসে মিশেছে। এই মিলিত প্রবাহ থেকে জন্ম নিয়ে বয়ে গিয়েছে তিস্তা। লাচুং থেকে ইয়ুমথাঙের দূরত্ব ২৪ কিমি। গ্রাষ্মকালে ইয়ুমথাঙে প্রায় ২৪ রকমের রডোডেনড্রনের দেখা মেলে। শুধু গ্রীষ্ম নয়, শীতেও ইয়ুমথাম যথেষ্ট আকর্ষণীয়। ইয়ুমথাং তেকে আরও ২৪ কিমি উত্তরে তিব্বত সীমান্ত ইয়ুমেসেমডং। উচ্চতা ১৫৩০০ ফুট এই পর্যন্ত পারমিট মেলে।

ইয়ুমথাং দেখা হলে চলুন গুরুদোংমার। লাচুং থেকে চুংথাং হয়ে লাচেন চু-কে সঙ্গী করে পৌঁছে যান লাচেন গ্রামে। চুংথাং থেকে লাচেনের দূরত্ব ২৯ কিমি। গুরুদোংমারের উদ্দেশে যেতে গেলে এখানেই রাত্রিবাস করতে হবে। পরদিন ভোর ভোর গাড়ি ছেড়ে রওনা থাঙ্গু গ্রামের উদ্দেশে। ১৪ হাজার ফুট উঁচু, প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টার রাস্তা। এই থহ্গু থেকে একটি রাস্তা চলে গিয়েছে চোপতার দিকে, সেটিও এই ট্যুরে দেখে নেওয়া সম্ভব। তিব্বতীয় রুক্ষ সৌন্দর্যের মধ্যে গাড়ি এগিয়ে চলে, যাত্রা শেষ হয় গুরুদোংমার লেকে। লাচেন থেকে দূরত্ব ৬৫ কিমি। বৌদ্ধ এবং হিন্দুদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র এই সরোবর।
কীভাবে যাবেন-
শিয়ালদহ থেকে দার্জিলিং মেল, উত্তরবঙ্গ, কাঞ্চনকন্যা ও তিস্তা তোর্সা এক্সপ্রেস ধরে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন। আর বাসে যেতে চাইলে ধর্মতলা থেকে শিলিগুড়ির বাস। নিউজলপাইগুড়ি বা শিলিগুড়ি থেকে গাড়িতে শেয়ার জিপে যাওয়া যায় গ্যাংটক।
গ্যংটক-ছাঙ্গুলেক-নাথু লা-আরিতার
ছাঙ্গুলেক যে কোনও সময় যেতে পারেন, কিন্তু তিব্বত সীমান্ত নাথু লা যেতে গেলে সপ্তাহে চারদিনই পারমিট মেলে বুধ, বৃহস্পতি, শনি, রবি। শহর থেকে ৩৮ কিমি দূরে ১২ হাজার ৪০০ ফুট উঁচুতে ছাঙ্গু লেক অবস্থিত। শীতে ছাঙ্গু লেকের জল জমে পুরো বরফ হয়ে ওঠে। ছাঙ্গুলেক থেকে কিছু দূরে বাবা মন্দির। চিন ভারত যুদ্ধে শহিদ বাবা হরভজন সিং নামে এক সেনাকর্মীর স্মৃতির উদ্দেশে এই মন্দির। কাছে আছে আরও একটি স্পট টুকলা। এখান থেকে হিমালয়ের নানা শৃঙ্গের দৃশ্য অসাধারণ। এবার যেতে পারেন ১৪৪৫০ ফুট উঁচুতে নাথু লায়। পুরো চড়াই পথ। নাথু লায় সীমান্তের ওপারে চিনা জওয়ানদের দেখা যায়। চিনের সঙ্গে চুক্তির পর এই পথ ধরে ভারত চিনের বাণিজ্য চলছে।
ছাঙ্গুলেক থেকে আরও একটি পথে চলে যাওয়া যায় সিকিমের আরিতার। গত কয়েক বছরে এই আরিতার হয়ে উঠেছে হট ডেস্টিনেশন। প্রায় সাড়ে ৫ ঘণ্টার পথ। পথে দেখে নিন কুপুপ লেক। অন্যদিকে গ্যাংটক থেকে রংপো হয়েও আরিতার লেকে যাওয়া যায়। লেকের এক পাড়ে একটি বৌদ্ধ মন্দির রয়েছে।
বার্সে-উত্তরে-পেলিং
পশ্চিম সিকিমের জনপ্রিয় জনপ্রিয় জায়গাগুলির মধ্যে অন্যতম বার্সে। হিলে থেকে ৪ কিমি দূরে বার্সে। মার্চ এপ্রিল মাসে এই পুরো পথটায় রডোডেন্ড্রনে ভরে থাকে। এই অঞ্চলে যেমন রয়েছে নানা ধরণের ফুল ও অর্কিড, তেমন কাঞ্চনজঙ্ঘার মায়াময় রূপ। বার্সেতে প্রায় সারা বছর পর্যটকেরা আসেন। এন জে পি থেকে জোরথাং হয়ে হিলে পৌঁছতে সময় লাগে প্রায় সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা। বার্সে থেকে জোরথাং হয়ে যাওয়া যায় রিনচেংপং। ৪৫ কিমি পথ। নিউজলপাইগুড়ি থেকে রিনচেংপঙের দূরত্ব ১৩৬ কিমি। এখান থেকেও অসাধারণ দৃশ্য মেলে কাঞ্চনজঙ্ঘা, রাথোং, কোকতাং, কুম্ভকর্ণ শৃঙ্গগুলির। রিনচেংপঙ একে একে দেখে নিতে পারেন হেরিটেজ হাউস, রিনচেংপং মনাস্ট্রি, পয়জন লেক, রবীন্দ্র স্মৃতি ভবন, রিসাম মনাস্ট্রি। আবার রিনচেংপং থেকে অনায়াসে ঘুরে নিতে পারেন হি বারমিওক স্পটটি। দূরত্ব ১৮ কিমি। হিমালয়ের কোলে একটি ছোট্ট গ্রাম। এখানে মূলত লিম্বু, রাই, নেওয়ার, মাঙ্গার জপজাতিদের বাস।
আরও পড়ুন-সিকিম কোন কৌশলে ভারতের অঙ্গরাজ্য হয়ে উঠেছিল
রিনচেংপং থেকে ৩৫ কিমি দূরে রয়েছে উত্তরে, পথে দেখুন সিংশোর ব্রিজ. এশিয়ার দ্বিতীয় উচ্চতম সেতু। পশ্চিম সিকিমের শেষ গ্রাম হল উত্তরে গোয়েচালা ও সিঙ্গালিলা ট্রেকের যাত্রীরা এখান থেকে রুট সেট করে থাকে। উত্তরের খুব কাছে আছে পেলিং। সিকিমের জনপ্রিয় এলাকা দূরত্ব ৩০ কিমি। এখান থেকেও কাঞ্চনজঙ্ঘাকে কাছ থেকে দেখা যায়। পেলিঙ দেখুন সাঙ্গাচোলি মনাস্ট্রি, পেমিয়াংশি গুম্ফা। ৩০ কিমি দূরে খেচিপেরি হ্রদ। পথে বেশ কয়েকটি ঝরনার দেখা মেলে, তার মধ্যে অন্যতম রিম্বি ও ছাঙ্গে।
পেলিং থেকে ৩২ কিমি দূরে রয়েছে সিকিমের প্রথম রাজধানী ইয়াকসাম। এখানেতিন বৌদ্ধ লামা প্রথম চোগিয়াল রাজাকে অভিষেক করেছিলেন। ইয়াকসামে দিন দুয়েক কাটালে নোরবুগাং, কাথক লেক ও দুবদি গুম্ফা দেখে নিতে পারেন। ইয়াকসাম থেকে কাছে রয়েছে কাঞ্চনজঙ্ঘা ন্যাশনাল পার্ক।
ভ্রমণসহ নানা খবরাখবর ও নানা অফার পেতে জন্য আমাদের টেলিগ্রাম চ্যানেলে যুক্ত হতে পারেন।