Breaking News

হাওড়ার অগ্নিযুগের প্রেক্ষাপটে হারানো এক গল্প, ‘হ্যামিলটন সাহেবের শয়তানি কলম’

পূর্ণেন্দু ব্যানার্জি-আজ যে কাহিনি বলবো, তা শিবপুর পুলিশ লাইনের। যদিও কাহিনির অন্তঃসার বুঝতে কিছুটা ভণিতায় যাবে।

সচল হোক বা জড় বস্তু, প্রত্যেক উপাদানকে অনুভব করতে গেলে কিছুর আধার প্রয়োজন। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। বিষয়টা বুঝতে একটু জটিল হল কি? তাহলে কিছু উদাহরণ দেওয়া যাক। বাতাস বা হাওয়াকে অনুভব করতে গেলে প্রয়োজন সজীব চর্মের। আলো বা কোনও বস্তুর অবয়বকে চিনতে প্রয়োজন দৃষ্টিপূর্ণ চোখ। আর আত্মা বা ভাইটাল ফোর্সকে উপলব্ধী করতে গেলে প্রয়োজন একটা সংবেদনশীল মন। আত্মা যখন দেহ ছাড়ে তখন সে সঙ্গে নিয়ে যায় স্মৃতিকে। আষ্ঠে পৃষ্ঠে জড়িয়ে। আর সেই স্মৃতিকণায় অবগুন্ঠিত থাকে কর্ম, মায়া, মমতা, হিংসা দ্বেষ।

যেমন কিছু মানুষ তার শয়তানি প্রবৃত্তিকে সুকৌশলে লুকিয়ে রাখতে পারে, তেমন কিছু বাড়ি বা সেই ব্যক্তির ব্যবহার করা আসবাবপত্র, বই, কলম বা মোহময়ী জিনিসও শয়তানি প্রবৃত্তির জন্ম দেয়। এক আশ্চর্য, অলৌকিক কিছু কর্মকাণ্ড ঘটায় যা এখনকার দিনে অবিশ্বাস্য ও যুক্তি তর্কের ঊর্ধ্বে। আর এমন উদাহরণ রয়েছে ভুরি ভুরি।

ঊনবিংশ শতকের ডেনমার্কের বিখ্যাত পদার্থ বিজ্ঞানী হল স্কটের কথাই ধরুন। তাঁর শরীরে কোনও সমস্যা ছিল না অথচ তিনি মৃত্যুর এক মাস আগেই উপলব্ধী করেছিলেন তিনি মারা যাবেন। সেকথা তিনি তাঁর নিজের ডায়েরিতে লিখে গিয়েছিলেন। তাঁর বাড়ির সামনে লাগানো একটি ঝাউগাছ কোনও কারণ ছাড়াই শুকিয়ে যাচ্ছিল, সেই ইঙ্গিতটাই তিনি পেয়েছিলেন নিজের জীবনে।

দ্বিতীয় উদাহরণ হল ঊনবিংশ শতকের বিখ্যাত বোটানিস্ট লন্ডনের বাসিন্দা উইলিয়ম অ্যান্ড্রুর। তিনি একবার স্বপ্ন দেখেছিলেন, গভীর জঙ্গলে গিয়ে এক নরখাদক গাছের পাল্লায় পড়েছেন। তাঁর হাত ও পা দিয়ে গাছের ডাল বেরিয়ে আসছে। এ কথা লেখা ছিল তাঁর নোটবুকে। ১৮৯২ সালের জুন মাসে তিনি নর্থ ক্যারোলিনায় গিয়ে একটি বিরল চারা গাছ দেখেন। সেই সময়ই তাঁর পায়ে ঝোপ জঙ্গলে কিছুতে আঁচড় লাগে।

ঘটনার পাঁচ দিনের মাথায় তিনি লক্ষ্য করেন বাঁ পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে কী যেন একটা বেরোচ্ছে। দু তিন দিন ছোলা ভিজিয়ে রাখলে যেমন অঙ্কুর হয়, অনেকটা সেই রকম। এবং প্রচণ্ড ব্যাথা। এর ঠিক দিন সাতেক বাদে তিনি লক্ষ্য করেন পায়ের প্রত্যেক গাঁট থেকে বাদামি রঙের হাড় বেরোতে থাকে, অনেকটা ছোট গাছ্রে ডালের মতো। অ্যান্ড্রু বুঝতে পারলেন, তাঁর দেখা দুঃস্বপ্ন সত্যি হতে চলেছে। মাস খানেকের মধ্যে মারা যান তিনি। ডাক্তারেরা অবশ্য বলেছিল এটা একধরণের বিরল জেনেটিক ডিসঅর্ডার। হাড়ের বিকৃতির ফলে এমন হয়।

ইতিহাস ঘাঁটলে এমন বহু উদাহরণ মেলে। এবার আসা যাক মূল কাহিনিতে। বাংলার গভর্নর তখন এন্ড্রু হেন্ডারসন লেইথ ফ্রজার। বকখালির কাছে যে ফ্রেজারগঞ্জ রয়েছে, তাঁরই নামে। অবিভক্ত ভারতে তক তিনটি প্রেসিডেন্সি, মাদ্রাজ, বেঙ্গল ও বোম্বে। সেই সময় সাহেবদের পাশাপাশি বাঙালিরাও হাইকোর্টের বিচারপতিদের আসনে বসতে শুরু করেছে। আর সেই সময়ই হাওড়ার শিবপুর, সালকিয়া, ঘুসুড়ি, আমতা অঞ্চলে বিপ্লবীদের কর্মকাণ্ড জোর কদমে শুরু হচ্ছে। ভারতে জাতীয় কংগ্রেস রাজনৈতিক পথ চলা শুরু করেছিল অনেক আগে, কিন্তু তাদের চালচলন ছিল অত্যন্ত নমনীয় ও শম্বুক গতি। দেশের এলিট গ্রুপের স্বদেশী ভাবনা, প্রতিবাদ, সবটাই চলছিল ঢিমেতালে। সেই সময়ই কংগ্রেসের মধ্যেই একদল তরুণতুর্কি চরমপন্থীর পথ নেয়।

১৯০৩ কলকাতা হাইকোর্টের এক কোর্ট অফিসার ছিলেন জেমস হ্যামিলটন। একেবারে সাক্ষাত শয়তান। দীর্ঘ ৩০০ বছরে ব্রিটিশরাজে বহু কুখ্যাত সাহেবের কথা উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু হ্যামিলটন সাহেব ছিলেন তাদের রাজা। বর্তমানে যেখানে পুলিশ লাইন, সেখানে একসময় ছিল সাহেব বাংলো। টুকরো সেনা ছাউনি এবং পুলিশ কোয়ার্টার্স। মূল গেট দিয়ে ঢুকে সোজা পুবে গঙ্গামুখী কোনার দিকে ছিল জেমস হ্যামিলটন সাহেবের বাংলো।

জেমস হ্যামিলটন। প্রায় সাড়ে ছ ফুট লম্বা, দশাসহী বলিষ্ঠ চেহারা। মাথায় সামান্য সামনের দিকে টাক আর ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি। অত্যন্ত ধুরন্ধর ও শয়তান। ভারতীয়দের চূড়ান্ত ঘৃণা করতেন। যদিও সুন্দরী ভারতীয় মহিলাদের প্রতি তার আসক্তি ছিল প্রবল। আর তার যাবতীয় কুকর্মে ছিল দুই সাগরেদ শিবপুর থানার ইন্সপেক্টর ইন্দ্রনাথ তালুকদার ও মইনুদ্দিন মোল্লা।

ইন্দ্রনাথ তালুকদারের বাবা ছিল, তিনকড়ি তালুকদার। দ্বাভাঙ্গা এস্টেটের তিনটি তালুকার কর আদায় করতো। অর্থিক নয়ছয় ও উদ্দাম জীবন যাপনের জন্য তার চাকরি যায়। যদিও তিনি এক সাহাবের বিশেষ আস্থাভাজন থাকায় নিজের চাকরি জুটিয়ে নেন ও ছেলের একটি পুলিশে চাকরির বন্দোবস্ত করান। ইন্দ্রনাথ পুলিশে চাকরি পাওয়ার পর থেকে নিজেকে প্রায় বড়লাট ভাবতে শুরু করেন। শিবপুরে আসার পর থেকেই প্রথম গণ্ডগোল শুরু হয় স্থানীয় জমিদার রায়চৌধুরীদের সঙ্গে। অবশ্য রায়চৌধুরীদের সঙ্গে আসল গণ্ডগোলটা ছিল হ্যামিলটন সাহেবের।

একবার নিজের জুড়ি গাড়ি করে পাথুরিয়াঘাটা যাচ্ছিলেন অবনীকুমার রায়চৌধুরী। সেই সময় আরও একটি ফিটনে চেপে হাইকোর্ট যাচ্ছিলেন হ্যামিলটন সাহেব। চলার পথে ওভারটেক করার সময় জমিদারের গাড়িকে ধাক্কা মারে সাহেবের গাড়ি। দোষটা ছিল সাহেবের গাড়ির চালকের। কিন্তু হ্যামিলটন সাহেব গাড়ি থামিয়ে রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে অবনীকুমারের গাড়ির চালককে প্রথমে বলেন, ব্লাডি ব্ল্যাক ইন্ডিয়ান। তারপর তিন থাপ্পড় মেরে নিজের গাড়িতে চেপে চলে যান।

সেই দিন সন্ধেবেলা পুলিশ লাইনের মূল গেটের সামনে নিজের গাড়িতে করে অপেক্ষা করতে থাকলেন অবনীকুমার। হ্যামিলটন সাহেবের গাড়ি গেটের কাছে আসতেই, জমিদার বাড়ির সদস্যকে দেখে নীচে নেমে আসেন। ঠিক সেই সময়ই অবনীকুমার কয়েক পা এগিয়ে হ্যামিলটন সাহেবের বাঁ দিকের গলায় একটা সপাটে থাপ্পড় মারেন। গলায় একটি চড় খেয়ে পুরো শরীর একপাক ঘুরে ছিটকে পড়েন হ্যামিলটন সাহেব। এরপর পাক্কা দু মিনিট ওখানে দাঁড়িয়ে থাকেন অবনীকুমার। আর সাহেব মাটিতে পড়ে কাতরাতে থাকেন। গেটের কাছে গার্ড থাকলেও অবনীকুমারকে দেখে কাছে ঘণেষতে পারেনি তারা। অবনীকুমার কোনও কথা না বলে নিজের গাড়িতে চেপে চলে যান। এই ঘটনার পর থেকে হ্যামিলটন সাহেবও রায়চৌধুরী পরিবারকে সমীহ করে চলতো।

এলাকায় রায়চৌধুরী পরিবারের দাপট থাকার মূল কারণ ছিল, জমিদার বিজয়কুমার চৌধুরী শিবপুরের চটকল তৈরির সময় ইংরেজদের বেশ কিছু জমি দান করেছিলেন। এমনকী ইংরেজদের টাকাও ধার দিতেন। জমি দানের সময় চুক্তিতে বলাই ছিল, এলাকার শিক্ষিত যুবকদের আগে নিতে হবে। আর প্রমাণ ছাড়া কোনও অজুহাতে কারও চাকরি গেলে কারখানা দখল নেওয়া হবে। সব দিক থেকে বিচার করলে, এলাকায় রায়চৌধুরী পরিবারের প্রবল প্রতাপ ছিল।

এবার আসা যাক হ্যামিলটন সাহেবের আর এক শাগরেদ মইনুদ্দিন মোল্লার ব্যাপারে। বাইরে আপাদমস্তক ধর্মপ্রাণ মানুষ। সাত চড়ে রা নেই। গলা সবসময় অত্যন্ত নীচু, গদগদ ভাব। দিনে পাঁচবার নামাজ আদা করা ছিল তার পুরনো অভ্যাস। আর তার কাজ ছিল, যেন তেন প্রকারে গ্রামের সুন্দরী মহিলাদের সাহেবদের কাছে ভেট চড়ানো। কোনও মহিলা যদি রাজি না হত, তাকে কীভাবে রাজি করাতে হবে, সেই কুবুদ্ধিও সাহেবদের দিত মইনুদ্দিন। ১৮৯৬-৯৭ সালে মাত্র ২৫ বছর বয়সে মইনুদ্দিন অধুনা বাংলাদেশের গোয়ালন্দ ঘাটে একটি নিজস্ব পতিতালয় খুলে ফেলেছিল। দুটি খুনের মামলায় তার নাম জড়ায়। যশোর আদালতে তার ১০ বছরের জেল হয়। আপিল করে হাইকোর্টে ফলে কলকাতায় আসা যাওয়া লেগেইছিল। পরিচয় হয় হ্যামিলটন সাহেবের সঙ্গে। এরপরেই তার মামলাটি কলকাঠি নেড়ে হিমঘরে পাঠিয়ে দেন সাহেব। সেই থেকে মইনুদ্দিন ঘাটি গাড়ে শিবপুরে।

প্রায় বছর খানের কেটে গিয়েছে, এদিকে শিবপুর ও আশে পাশের অঞ্চল ছাড়াও আমতা, উদয়নারায়ণপুর, আন্দুল অঞ্চল থেকে বহু কিশোরী ও মহিলা উধাও হওয়ার খবর আসতে থাকে। সেই সঙ্গে বহু যুবক ও ব্যক্তির বিরুদ্ধে স্বদেশী করার জন্য মামলাও হতে থাকে। শিবপুর সালকিয়ায় স্বদেশী আন্দোলন দানা বাঁধছিল ফলে প্রথমে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। বারবার এমন অদ্ভুত খবর কানে আসার পরে সেই নড়ে চড়ে বসেন অবনীকুমার। তিনি বিষয়টি জানান ফোর্ট উইলিয়মে কর্মরত এক উচ্চপদস্থ আধিকারিক ফ্রান্সিস উড সাহেবকে। তিনি ডি আইবি মারফত খবর জোগাড় করে চমকে উঠলেন।

ক্রমশঃ- পরবর্তী অংশের জন্য এখানে ক্লিক করুন

কাহিনির পরবর্তী অংশগুলি জানতে আমাদের টেলিগ্রাম চ্যানেলে যুক্ত হতে পারেন।

আরও পড়ুন- নৃসিংহপুরের রাজবাড়ি কেন অভিশপ্ত?

আরও পড়ুন- আন্দুলরাজবাড়ি নিয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য ও ভুতুড়ে গল্পকাহিনি

আমাদের চ্যানেলে যুক্ত হয়ে যান

About Orbit News

Check Also

ঠোঙা একটি এলোমেলো সফরের কাহিনি

পূর্ণেন্দু ব্যানার্জি- জীবনে কিছু কিছু ঘটনা ঘটে ‌যার ব্যাখ্যা হয়তো বিজ্ঞান বা ‌যুক্তিশাস্ত্রের কাছে থাকে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!