স্বাতী চ্যাটার্জি- প্ল্যানটা ছিল প্রায় মাস দুয়েক আগে থেকেই। অধিকাংশ সদস্যের চাহিদামতোই সফরসূচি পরিকল্পনা করা হয়, জগদলপুর, ছত্তিশগড়। ২জন শিশুসহ প্রায় ১৮ জনের টিম তৈরি হয়। আর সেই টিমে অধিকাংশই মহিলা। ১২ জন।
প্রস্তুতিমতো ট্রেনের টিকিট কাটা হয়ে যায়। মাওবাদী আতঙ্ক থাকলেও, জগদলপুরে সেভাবে কোনও আতঙ্ক নেই। প্রায় ২ দিন অন্তর বহু বাঙালি সফর সেরে আসছেন এবং তা ফেসবুকের স্টেটাস আপডেটে প্রতিফলিত। যদিও আমাদের এই ট্যুরের সঙ্গে সংযোজিত ছিল দান্তেওয়াড়া। সেখানেও প্রায় বছর খানেক যাবৎ কোনও ঘটনা তেমন ঘটেনি। তবে বাধ সাধল, ছত্তিশগড়ে ভোটের দামামা বাজার পরেই। আমাদের জার্নির তারিখ ছিল ১৫ নভেম্বর ২০১৮ এবং ফেরা ২০ নভেম্বর ২০১৮।
আমাদের জার্নির বেশ কয়েকদিন আগেই ভোটের দিন ঘোষণা হওয়ায় কিছুটা চাপ তৈরি হল। ১২ তারিখ ভোট, বস্তার, দান্তেওয়াড়া, কাঁকের, সুকমা, নারায়ণগড়, বীজাপুর এই সব অঞ্চলে। আর বস্তার ছাড়া বাকি পুরে অঞ্চলই মাওবাদীদের মুক্তাঞ্চল। ফল যা হওয়ার তাই। ১২ তারিখ ভোটের ঠিক পাঁচ ছদিন আগেই মাওবাদীরা নিজেদের উপস্থিতি জানান দিল দান্তেওয়াড়ায়। সিআরপিএফ কর্মীদের সঙ্গে মৃত্যু হল এক চিত্রসাংবাদিকের।এই খবর প্রকাশ্যে আসার পরেই আমাদের সদসদের মধ্যে শুরু হল উচাটন।

এখানেই শেষ নয়, ক্লাইমাক্স বাকি ছিল, আমাদের জার্নি ছিল ১৫ তারিখ। আর ঠিক ভোটের আগের দিন ১১ তারিখ ফের দান্তেওয়াড়ায় নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার ঘেরাটোপকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে হামলা চালালো মাওবাদীরা। সেখানেও তিন সিআরপিএফ কর্মীর মৃত্যু।
এই ঘটনার আগে পর্যন্ত প্রায় সব সদস্যই পিছু পা হতে চায়নি। এবং জায়গাটি দান্তেওয়াড়া জেনেও। কিন্তু ভোটের ঠিক আগের দিনের ঘটনায় এক সদস্য যাত্রা বাতিলের সিদ্ধান্ত নিলেন। তারপরেই বাকি সদস্যদের প্রত্যেককে ফোনে তাঁদের অভিপ্রায় জানতে চাওয়া হয়।
এখানে বলে রাখি, এই গ্রুপে অধিকাংশই ছিলেন বয়স্ক মহিলা, এবং তাঁদের সঙ্গী ছিলেন না পরিবারের কোনও সদস্য। প্রায় প্রত্যেকের একটি কমন প্রশ্ন ছিল, আমরা যাচ্ছি কিনা?
প্রশ্নের উত্তর সদর্থক থাকায়, তাঁরাও রাজি হয়ে যান।
এর পরেই লোকাল সোর্সকে ব্যবহার করে সফরসূচি রূপায়ণ করি। এক সদস্য সফর বাতিল করলেও, সেই জায়গায় জুড়ে গেলেন আর এক সদস্য।
আমরা বেশ কয়েকটি গ্রুপ ট্যুর করেছি, কিন্তু সেগুলির তুলনায় এবারের গ্রুপ ট্যুর ছিল কিছু ভিন্ন, বলা ভালো কিছুটা সংবেদনশীলও। কারণ এতো বড় টিমে অধিকাংশ ছিল বয়স্ক মানুষ, যাঁদের মধ্যে অধিকাংশ একা সর্বপরি অপরিচিত।
তাই যাত্রাপর্বের আগে থেকেই ভার্চুয়ালি পরিচিতি পর্ব এবং আলোচনা, আড্ডার ব্যবস্থা করা হয়। যাতে যাত্রার সময় কারও কোনও অস্বস্তিকর পরিবেশ না থাকে এবং পুরো জার্নিটাই জমজমাট হয়। বলা বাহুল্য, আলোচনা ও আড্ডা পর্বে কয়েকজন ছাড় বাকিরা দর্শকই ছিলেন।
যদিও শুরুটা ভালোই হল, ১৫। ১১। ১৮ রাত সাড়ে নটা। ট্রেন ছাড়ল হাওড়া স্টেশন থেকে। পোলাও, পনির বাটার মশলা এবং আলুরদম দিয়ে রাতের খাবার সারা হল।
জগদলপুর পর্ব ২
জগদলপুর সফরে এবারে অধিকাংশই ছিলেন নতুন সদস্য। পুরনো সদস্য বলতে স্বপনকাকু (দত্ত) অনুরাধা কাকিমা। ছিলেন মঞ্জুলাদি (ঘোষ) তিনি প্রত্যক্ষভাবে আমাদের আগের কোনও ট্যুরে না থাকলেও, তিনি সফরসঙ্গী থাকতেন তাঁর স্বামীর সৌজন্যে। অমিতাভদা আমাদের সঙ্গে বেশ কয়েকটি ট্যুর করেছেন, বেশ মজার মানুষ এবং সবচেয়ে ফিট ট্রাভেলার। মঞ্জুলাদিও ঠিক তেমনই, তবে পার্থক্য এক জায়গা সেটা হল পযর্বেক্ষণ, ট্যুরে থাকলেও, ওনার চোখকে ফাঁকি দিয়ে মাছিও গলতে পারে না।

শারীরিক সমস্যা থাকলেও, মনের জোরে কাজ সম্পন্ন করে থাকেন, সেটা যে না দেখেছে, তাঁর পক্ষে বিশ্বাস করা কঠিন। আমি রেকমেন্ড করবো, কেউ কোনওদিন সুযোগ পেলে মঞ্জুলাদির সঙ্গে বেড়াতে যান, ওনার কাছে অনেক কিছু শেখার আছে। বিশেষ পযর্বেক্ষণ ক্ষমতা।
এবারে অধিকাংশ নতুন সহাত্রীদের পরিচিতি পর্বগুলি একটু সেরে নেওয়া যাক। পাপিয়া দে, স্বাতী ঘোষ, এরা দুজনেই প্রায় ভ্রমণ পোকা গোছের হাতের কাছাকাছি কোনও ছুটি পেলেই দে দৌড়। পল্লবী চক্রবর্তী আসলে সোলো ট্রাভেলার, নিজেই রানি। যদিও গ্রুপ ট্যুরে গিয়ে গ্রুপের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে ১ নম্বরে জায়গা করে নিয়েছে। এটাই সম্ভবত তার কোনও অপরিচিতদের সঙ্গে প্রথম গ্রুপ ট্যুর।
কেয়া চ্যাটার্জি, তিনিও এই প্রথম কোনও অপরিচিতদের সঙ্গে গ্রুপ ট্যুরে বেরোলেন। তাঁর মনে একটু শঙ্কা ছিল কেমন হবে, বা তাঁকে কে কতটা মানিয়ে নিতে পারবেন তা নিয়ে, যদিও তিনি গ্রুপের সঙ্গে যথেষ্ট মানিয়ে নিয়েছিলেন। যদিও ওনার জার্নিটা ছিল কিছুটা নাটকীয়, উনি যে সময় জগদলপুর যেতে চেয়েছিলেন, সেই সময় টিম ফুল ছিল। পরে এক সদস্য ট্যুর বাতিল করায়, উনি প্রায় ওয়াইল্ড কার্ড এন্ট্রি পান।
আলপনাদি (রায়চৌধুরী) ওনার ব্যাপারে নতুন কিছু বলার নেই, উনি আমাদের সঙ্গে বেশ কয়েকটি ট্যুর করেছেন। ওনার মতো ট্রাভেলার পাওয়া সত্যি ভাগ্যের ব্যাপার, ওনার সঙ্গে যাঁরা ট্রাভেল করবেন একমাত্র তাঁরাই অনুভব করতে পারেন, যে কোনও পরিস্থিতিতে উনি কতটা সাপোর্টিভ।
আর টাইম জ্ঞান নিয়ে অ্যাডমিন দম্পতিও কয়েকবার দশ গোল খেয়েছে। তবে উনি প্রায় কোনও না কোনও ট্যুরে একজন করে নতুন সদস্যের পরিচিতি ঘটান, দেওঘরে ছিলেন পূর্ণাদি এবারে নীতাদি (চট্টরাজ) যাত্রার দিনই তিনি নিজের পরিচিত পর্বে বুঝিয়েছিলেন, পুরো জার্নিটাকেই কলেজ ক্যাম্পাস বানাতে চলেছেন। হাসি, ঠাট্টা, ইয়ার্কি আর মজা করার ক্ষেত্রে সেরা শিরোপা ছিনিয়ে নিয়েছেন। বলা ভালো কাযর্ত মাইলস্টোন পুঁতে দিয়েছেন, যে ট্যুরে উনি থাকবেন, সেই ট্যুরই হবে জমজমাট।
প্রায় অনেক দিন ধরেই যাবো যাবো করে আর হয়ে ওঠেনি, কিন্তু সময়, সুযোগ, ছুটি মিলে যাওয়ায় জুড়ে গেলেন অর্পিতা এবং তাঁর মা। আড্ডায় খুব বেশি যোগ না দিলেও, অসাধারণ উৎসাহদাতা দর্শক। এবারে নতুন যোগ দিলেন অরুণাভদা (ঘোষ), অরুণাভদার প্রসঙ্গে একটা কথা না বললেই নয়, উনি ভ্রমণপ্রিয়তো বটেই, সাপোর্টিভ এবং প্রচণ্ড অ্যাকোমোডেটিভ। শুধু তাই নয়, যাত্রার বেশ কয়েকদিন আগে থেকেই তিনি সবচেয়ে বেশি উৎসাহী ছিলেন এবং হোয়্যাটস অ্যাপ গ্রুপে প্রায় রোজই কাউন্ডডাউন নোট দিতেন।

ছিলেন বর্ণালীদি (মজুমদার) এবং ত্রিদিবদা (আডড্য) ওনারাও যথেষ্ট কো-অপারেটিভ এবং সাপোর্টিভ ট্রাভেলার। এই প্রথমবার গেলেও, মনে হয়নি নতুন যাচ্ছেন।
এই পর্বে পরিচিতি পর্ব সারলাম তার দুটো কারণ, এঁরা প্রত্যেকেই ট্যুরিস্ট মনোভাবাপন্ন নন, সম্পূর্ণ ট্রাভেলার মানসিকতার। দ্বিতীয় যে খানে শেষ মুহূর্তে এই ট্যুরটি বাতিল হওয়ার প্রভূত আশঙ্কা ছিল, একমাত্র এনাদের সহযোগিতার জন্যই এই ট্যুর সম্পূর্ণ হয়েছে। ছত্তিশগড়ে ভোট এবং দান্তেওয়াড়ায় মাওবাদী হামলার পরেও এঁরা যাওয়ার সাহস দেখিয়েছেন।
১৫ তারিখ রাতের জার্নিতো ভালোই কাটল, এক সমস্যা দুপুরের দিকে, সকালে ইডলি দিয়ে ব্রকফাস্ট হলেও, দুপুরের খাওয়া নিয়ে বেশ সমস্যা দেখা দিল। একে লং জার্নির ট্রেনে প্যান্ট্রি নেই, তার উপরে যে স্টেশনগুলিতে ১০ থেকে ২০ মিনিট দাঁড়ায়, সেই সব কটি স্টেশনই যেন কালাহান্ডি।
বছর চারেক আগেও স্টেশনগুলিতে কিছুটা ভদ্রসভ্য খাবার পাওয়া যেত, কিন্তু সেগুলিও অমিল। যাওয়ার সময় কৌশল জানা ছিল না, পূর্ব অভিজ্ঞতায় ভর করে ট্রেনে খাবারের অপেক্ষায় থেকে বেশ বেগ পেতে হল। তাই একটি পরামর্শ স্লিপার ছাড়িয়ে এসি কামরার দিকে যান, কয়েকজন অ্যাডভান্সড স্টেশন বুকিং নেয়, তাদের ধরে খাবারের অর্ডার দিন, নয়তো লটারির অপেক্ষায় থাকতে হবে।
এদিনের প্রায় দুপুরের খাবারের ব্যাপক সমস্যা হলেও সদস্যদের ব্যক্তিগত সহযোগিতায় কালের দশা কেটেছিল। আড্ডা, গল্প, ট্রেনের থেকেই মনোরম দৃশ্যের ছবিতোলা এমনই হাজারো ব্যস্ততার মধ্যেই ট্রেনে রাতের ডিনার সেরে রাত প্রায় বারোটা নাগাদ পৌঁছালাম জগদলপুর।
স্টেশনের বোর্ড আর আলোকে পিছনে রেখেই তোলা হল গ্রুপ ছবি, সৌজন্য পাপিয়া। ছবি দেখে মনে হতে পারে, পাপুয়া নিউগিনির এয়ারপোর্ট থেকে সদ্য আমাদের ডিপোর্ট করা হয়েছে, কিন্তু আমার ব্যক্তিগতভাবে খুব পছন্দের ছবি। এই আবহ ও পরিবেশের আসল মেজাজটাই ফুটে উঠেছে। অনেকটাই আমাদের ট্যুরের মতো। নিখাদ, নির্ভেজাল। এলোমেলো, বাউন্ডুলে।
জগদলপুর পর্ব ৩
কথা ছিল জগদলপুর সফরের প্রথম দিনটা থাকবে স্থানীয় এলাকার সঙ্গে কাঙ্গের ঘাটি, কুটুমসার গুহা, তিরৎগড় জলপ্রপাত এবং চিত্রকোট জলপ্রপাত। একদম সকালেই তাই প্ল্যান ছিল, কিন্তু কার সঙ্গে ফোনে কথা বলার পরেই দুম করে প্ল্যান চেঞ্জ করলো পূর্ণেন্দু। বলা হল আজ স্থানীয় নয়, আজই দান্তেওয়াড়া।

আমি জিজ্ঞেস করলাম দান্তেওয়াড়াতো রবিবারের পরিকল্পনা ছিল, চেঞ্জ কেন হল? তাতে উত্তর এলো, শনিবার মায়ের পুজোর দিন, এটাই বেটার। উত্তরটা আমার কাছে তেমন ঠিক লাগলো না, ফের একবার জিজ্ঞেস করলাম, কাল করলেওতো হয়, আর কোনও উত্তর পেলাম না, তবে এটা বুঝলাম, নিশ্চয়ই কিছু একটা ব্যাপারের জন্য প্ল্যান চেঞ্জ হয়েছে। তবে আমিও বিশেষ ঘাঁটাইনি, আদার ব্যাপারী বলে কথা। অগত্যা সকালে আলুপরটা খেয়ে গাড়িতে বসা ছাড়া উপায় ছিল না।
বস্তার জেলার সীমা পেরিয়ে দান্তেওয়াড়া সীমানায় ঢোকার সময়ই টের পেলাম, স্থানীয় এলাকার ছবিটা প্রায় আমূল বদলে গেল, ঝাঁ চকচকে খাঁ খাঁ করছে রাস্তা, মোটারবাইক আর প্রাইভেট গাড়ি ছাড়া বাস, লরির তেমন দেখা নেই। হাই রোডে এমনকি কোনও পুলিশ পেট্রোলিং টিমও নেই। মাঝে মধ্যে জঙ্গল আর কিঞ্চিৎ পাহাড়ি রাস্তা।
গভীর জঙ্গলের বুক চিরে চলে গেছে গ্রামের পথ। আমাদের প্রথম গন্তব্য ছিল দন্তেশ্বরী মন্দির, সতীপীঠের অন্যতম। দেবীর এখানে দাঁত পড়েছিল বলে কিংবদন্তি রয়েছে। মন্দিরের সামনেই রয়েছে, শঙ্খীনি ডাকিনি নদী। পরিবেশ বেশ মনোরম। এই মন্দিরে প্রবেশের কিছু বিধি নিষেধ রয়েছে, জিন্স, টপ গোছের জামাকাপড় পরলে গর্ভগৃহে প্রবেশ নিষেধ। যদিও মন্দির চত্বরে মহিলাদের জন্য শাড়ি এবং পুরুষদের জন্য ধুতির ব্যবস্থা রয়েছে পুরোপুরি ফ্রিতে। ভিড় প্রায় নেই বললেই চলে, স্থানীয় বাসিন্দা ছাড়া, হাতে গোনা গুটি কয়েক পর্যটক, আমরা ছাড়া দুজন বাঙালিকে দেখা গেল, যদিও তাঁরা জগদলপুরেই থাকেন কর্মসূত্রে।

পরবর্তী গন্তব্য, বাসুর, এটিও দান্তেওয়াড়া জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রামে পর্টন কেন্দ্র। জোড়া গণেশ মন্দির, মামা ভাগ্নে মন্দির এবং বাসুর মন্দির। তিনটি এলাকাতেই প্রাচীন পুরাকীর্তি রয়েছে। তবে এলাকাগুলি পর্যটকদের প্রায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। এলাকার মানুষদের কাছে আমরাই যেন দর্শনীয় বস্তু। রাজনৈতিক সমস্যা না থাকলে এই এলাকাগুলি আরও বেশি উন্নত হতে পারতো, এলাকার মানুষগুলোর উপকার হত।
এ দিন মোটামুটি এই জায়গাগুলি ঘুরেই বিকেল বিকেল হোটেলে। পরিকল্পনা ছিল, হোটেলে অনেক আগে ভাগে ফেরা হয়েছে, তাহলে কিছু আড্ডা, গল্পগুজব করা যাক। কিন্তু কে শোনে কার কথা, সন্ধে নাগাদ, একটা দল স্বপনকাকুদের নেতৃত্বে বেরিয়ে পড়ল বাজারের দিকে মার্কেটিঙে, আর আমরা কয়েকজন বেরোলাম পায়চারী করতে।
আর এখানে ঘটল এক অদ্ভুত মজাদার ঘটনা। এলাকা এক্সপ্লোর করতে গিয়ে দেখা গেল, একটা জায়গা থেকে বেশ আলোর ছটা বেরোচ্ছে, মনে হল, কোনও বড় অনুষ্ঠান রয়েছে, সে দিকে এগনো শুরু হল। কিছুটা হাঁটার পর মনে হল, নিশ্চয়ই কোনও বিয়ে বাড়ি, কে যেন বললো, তাহলে পাত্র বা পাত্রী পক্ষ বিচার করে, রাতের ডিনারটাই এখানে সেরে নেওয়া যায়।
কাছে গিয়ে জানা গেল, একটি বাচ্চার জন্মদিন পালন হচ্ছে, এবং বাড়িটির সামনে তিন চারটে বাচ্চা খেলা করছে। পুরো খোঁজখবর নিলেন মঞ্জুলাদি। বিষয়টি জানার পরে, সবাই চক্রাকারে অন্ধকার রাস্তা ধরে আবার বড় রাস্তায় এসে পড়লাম। চলল নিজেদের মধ্যেই ফাজলামি।
কয়েকবার এদিক ওদিক তাকিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হল, বাজারের দিকে যাওয়ার। বাজারেই একটা বেশ সাজানো গুরুদ্বয়ারা রয়েছে, সেখানে আমরা ঢুকলাম, এদিকে একটি ফুচকার দোকান পেয়ে পল্লবী আর মঞ্জুলাদি অভিযান চালালেন।
রাস্তার একপাশে আমরা অন্য পাশে ওরা দুজন, মুচকি হাসির সঙ্গে ফুচকা খাওয়ার দৃশ্য, সেটা বর্ণনা করা আমার পক্ষে মুশকিল।
এরপর পল্লবীর চকোলেট পার্টি, আমাদের চা পার্টি সেরে, হোটেলে ফেরৎ। ইচ্ছে ছিল আড্ডার কিন্তু তা আর হল না, হোটেলের রেস্তরাঁয় খাবার খেয়ে যে যার রুমে। পরের দিন সকালে খাবার খেয়ে এক গাদা জায়গা যাওয়ার পরিকল্পনা।
অন্তিম পর্ব
১৮-১১-১৮। এদিন যাত্রাটা ছিল অনেকটাই ঘরোয়া নিশ্চিন্তের। ফলে প্রত্যেকের চাহিদা মতোই সকালে প্রাতঃরাশ সারে। পদে ছিল আলুর পরোটা। কেউ একটি , কেউ দেড়খানা, কেউবা দুটি খেলেন।
এদিনের প্রথম গন্তব্য ছিল, বস্তার রাজবাড়ি। এখানে প্রতিষ্ঠিত রয়েছেন কুলদেবী দন্তেশ্বরী। (দন্তেওয়াড়ার দন্তেশ্বরী মাতার থেকে অনুপ্রাণিত) এই রাজবাড়ির একটি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস প্রকাশ করা যাক। একটা সময়ে বস্তার সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল পুরো দণ্ডকারণ্য এলাকা জুড়ে। রামায়ণের সূত্র যদি ধরা হয়, কোশল সাম্রাজ্য যতটা বিস্তৃত ছিল, তার অনেকটাই।
ঐতিহাসিকদের মতে, বস্তার সাম্রাজ্যের সূচনা হয় নল রাজা ভবদত্ত বর্মনের হাত ধরে। তারও অনেক পরে এটি আসে কাকতীয় রাজাদের হাতে। হায়দরাবাদে গোলকোন্ডা ফোর্টে যে কাকতীয় রাজবংশ রাজত্ব করতো, এখানে তাদেরই একটি অংশ।
মারাঠা সাম্রাজ্য উত্থানের আগে পর্যন্ত এই রাজ্য স্বাধীন ছিল। সেটি সপ্তদশ শতকে। তারও আগে চোদ্দ শতকের শেষ দিকে বস্তার সাম্রাজ্যের দুটি ভাগ হয়। একটি কাঁকের অন্যটি দান্তেওয়াড়ার বাসুরে। সপ্তদশ অষ্টদশ শতক পর্যন্ত বস্তারের মূল সাম্রাজ্যর রাজধানী ছিল বাসুরে। পরে এই জগদলপুরে এই রাজপ্রাসাদ তৈরি করা হয় এবং রাজধানী স্থানান্তর করা হয়। বস্তারে কাকতীয় রাজবংশের কথা ধরলে দিগপাল দেও রাজত্ব শুরু করেন।

বর্তমানে এই প্রাসাদে তিনটি শরিক রয়েছে, বিজয়চন্দ্রভঞ্জ দেও, ভারতচন্দ্র ভঞ্জ দেও, কলমচন্দ্র ভঞ্জ দেও। স্বাধীন ভারতের আগে পর্যন্ত এই সামাজ্যের শেষ রাজা প্রবীরচন্দ্র ভঞ্জ দেও।
এই প্রাসাদের অন্দর মহলে প্রবেশ নিষেধ সাধারণদের জন্য। যদিও বাইরে থেকে প্রাসাদ দেখা যায়। আর মূল প্রবেশ সভা ঘরে একটি সোনায় মোড়া সিংহাসন রয়েছে, এবং প্রবীরচন্দ্র ভঞ্জ দেওর ছবি রয়েছে।
বস্তার রাজবাড়ি সফরের পর পরবর্তী গন্তব্য ছিল, দলপত সাগর লেক। প্রায় ৪০০ বছর আগে এই বস্তারের রাজা দলপত দেও, কৃত্রিম এই দিঘি খনন করান। মূল উদ্দেশ্য ছিল, বৃষ্টির জলকে ধরে রাখা এবং স্থানীয় এলাকায় সেচের কাজে ব্যবহার করা। বর্তমানে সরকারের তরফে লেকটিকে সাজানো হয়েছে। শীতে এখানে প্রায় ৫২টি প্রজাতির পরিযায়ী পাখি আসে বলে দাবি স্থানীয়দের। রয়েছে বোটিঙের ব্যবস্থা।
সকাল প্রায় ৯টা এবার আমাদের গাড়ি চলল কাঙ্গের ঘাটির উদ্দেশে। এই কাঙ্গেরঘাটিতে। এখানে প্রায় বছরখানেক হল একটি নতুন নিয়ম চালু হয়েছে। আপনি যদি গাড়ি ভাড়া করে যান, তাহলে কাঙ্গেরঘাটির বাইরে সেই গাড়ি রেখে দিতে হবে। ভিতরে প্রবেশ করতে হলে, বাইরে থাকা ফরেস্টের (কন্ট্রাক্টে দেওয়া) গাড়ি নিতে হবে ১৫০০ টাকা খরচ করে। যদিও আগে নিয়ম ছিল গাড়ি প্রতি ৫০ টাকা এবং জনপ্রতি ২৫ টাকা দিয়ে প্রবেশ করা যেত।
এখানে আরও একটি মজা রয়েছে, আগে কাঙ্গেরঘাটির চার পাঁচটি জায়গা এক্সপ্লোর করা যেত, কিন্তু ফরেস্টের গাড়িতে (কন্ট্রাক্টের) দুটি জায়গা ছাড়া দেখা মুশকিল। ১ )কুটুমসার গুহা (১ নভেম্বর থেকে খোলে) ২ কাঙ্গের ধারা। তবে এই কাঙ্গের ঘাটির মধ্যে আরও কিছু স্পট তৈরি করা হচ্ছে। এবং এই চত্বরে আরও দুটি গুহা রয়েছে, কৈলাস গুহা এবং দণ্ডক গুহা। এই দুটি গুহাই সাধারণ মানুষের প্রবেশ করার জায়গায় নেই, বেশ কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ।

কাঙ্গেরঘাটির প্রথম যাত্রা ছিল কুটুমসার গুহা। জায়গাটি যেমন রোমাঞ্চকর তেমনই রহস্যজনক। এই গুহার অন্দরে সূর্যের আলো পৌঁছয় না। হাইবিম টর্চ না থাকলে গুহার চালচিত্র বোঝা কিছুটা দুষ্করই। ঘাটি থেকে প্রায় ৭২ ফুট নীচে এবং ৩৩০ মিটার লম্বা এই গুহা। বৃষ্টির জল এবং বেরোনোর তিনটি পথ রয়েছে। বর্ষাকালে এই গুহা পুরোটাই জলে ভর্তি থাকে। গবেষকদের মত, এই প্রাকৃতিক গুহা তৈরি হয়েছে, কয়েক কোটি বছর আগে। ১৯০০ সালে এই গুহার প্রথম খোঁজ মেলে।
এবার আসি গুহার প্রবেশ পর্বে। আমাদের মতো যাঁরা স্লিম এবং কিঞ্চিৎ মোটা ও শরীর কিছুটা ফিট তাঁরা যেতে পারে। মূল পর্বে দুফুট চওড়া সিঁড়ি দিয়ে নেমে দেখা যাবে প্রায় তিনফুট ব্যসের গুহামুখ, এখানে ঘাড় গুঁজে, বসে নামতে হবে গোল ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে, একজন ব্যক্তি যেতে পারবেন। বয়স্ক মানুষ, বিশেষ করে যাঁদের পায়ের সমস্য রয়েছে এবং ভারী চেহারা তাঁদের পক্ষে যাওয়াটা কষ্টকর। তবে অসম্ভব বলবো না।
কারণ মঞ্জুলাদি এবং অনুরাধা কাকিমা যেভাবে গুহাতে ঢুকলেন, সেখান থেকে বলতে পারি কষ্টকর কিন্তু অসম্ভব নয়। তবে মনের জোরটা অত্যন্ত জরুরি। যদিও, কন্ফিডেন্স পেলেন না আলপনাদিদিও। আমার দেখা অনেকের থেকে তিনি অনেক বেশি ফিট। গুহার অন্তিমপর্বে রয়েছে, একটি শিবলিঙ্গ, সেটিকে স্থানীয়রা পুজো করেন।
গুহার বেশ কিছু অংশ এখন সাধারণের জন্য খোলা হয়নি। সেগুলি মার্ক করে রেখে দেওয়া হয়েছে। প্রায় দেড়ঘণ্টা কাটিয়ে কুটুমসারের পরের গন্তব্য ছিল কাঙ্গের ধারা। এই জায়গাটিও বেশ ভালো। অনায়াসে ঘণ্টা তিনেক কাটানো যায়, পাথরের গা বেয়ে নেমে আসার জলের ধারার মূর্চ্ছনা মোহিত করবেই। তবে ওই, গাড়ির চালকদের ডাক বড় বেমানান।
এখান থেকে বেরিয়ে এবার যাওয়া হল, তিরৎ গড় ফল্স। এখানে দেখালাম, সেই নিয়ম, নতুন করে ৫০ টাকা গাড়ি প্রতি এবং ২৫ টাকা জনপ্রতি দিয়ে যেতে হবে, তাই নয়, তিরৎগড়ে ঢুকতে স্থানীয়দের ট্যাক্স (পার্কিং ফিয়ের নামে) ।
নভেম্বর মাস, জল কম থাকাই স্বাভাবিক, তবে তিরৎগড়ের প্রৃতিক পরিবেশ যে কত সময় চুরি করে নেবে, কারও পক্ষে ধরা মুশকিল। ধাপে ধাপে নেমে আসা জলপ্রপাতের এই চরিত্র একদমই স্বতন্ত্র। দুপুর দুটো নাগাদ ওই অঞ্চলেই একটি ফুটের দোকানে সব্জি ভাত ডিমের ঝোল খাওয়া হল। জায়গাটি যতই অপছন্দের হোক, খাওয়াটি খারাপ ছিল না। অবশ্য কিছু করারও ছিল না। এখানে মঞ্জুলাদি খাবার পর, কিছুটা গড়িয়েও নিলেন দোকানদারের খাটিয়াতে। একদম ধ্রূপদী বাঙালিয়ানার ছাপ রাখলেন মঞ্জুলাদি।

পরবর্তী গন্তব্য চিত্রকোট জলপ্রপাত। তবে তার আগে এক ফাঁকে দেখে নেওয়া হল, তামরাঘুমোর। এই অঞ্চলটি একটা সময় মাও অধ্যুষিত ছিল। জায়গাটি পুরোটাই টেবিলল্যান্ড। সামনেই বিশাল খাদ। বর্ষায় এই টেবিল ল্যান্ড থেকে যখন খাদে জল ঝরে পড়ে তখন কী অনবদ্য দৃশ্যে রূপান্ত হয়, তা কল্পনা করাই যায়। প্রায় মিনিট দশেক কাটিয়ে চিত্রকোট। অনেকেই এটিকে ভারতের নায়াগ্রা বলে অভিহিত করেন, যদিও এই সমতুল শব্দপ্রয়োগে আমার ব্যক্তিগত আপত্তি রয়েছে, কারণ চিত্রকোটের নিজস্ব ছবিটাই অনবদ্য।
ইন্দ্রাবতী নদীর জল ঝরে পড়ার ছবি ভিন্ন দৃষ্টিকোন থেকে ভিন্নরকম। নীচে বোটিঙের ব্যবস্থা রয়েছে, কিছু সদস্য সেদিকে পা বাড়িয়ে ছবিও তুলে এনেছে কাছ থেকে। এই চত্বরেই ছত্তিশগড় ট্যুরিজিমের আবাসস্থাল রয়েছে, একটু কস্টলি। তবে সকাল বিকেল দুপুর, রাত সব সময়ের জন্য এই জলের ধারার রূপ দেখতে চাইলে এখানের হোটেল বুক করা উচিত।
আর সময় বাছা উচিত বর্ষাকাল মূলত অক্টোবর। তবে এই সময়ে কিন্তু কুটুমসার গুহা দেখতে পাবেন না, মাথায় রেখে। প্রায় সাড়ে ছটা পর্যন্ত কাটল চিত্রকোট চত্বরে। মায়াময় পরিবেশ মনকে কতটা যে আবেশ করে তোলে, তা এই জায়গায় না পৌঁছলে বোঝা মুশকিল, বোঝানোও।
হোটেলে ফিরে প্রত্যেক সদস্যের প্রায় গা ছেড়ে দেওয়ার জোগাড়। যথারীতি খাবার টেবিলে ধীর গতিতে আগমন এবং রেস্টুরেন্টের একাংশ কর্মীর অপেশাদার আচরণে উত্তপ্ত পরিবেশ। খাবার অর্ডার নেওয়ার পরেও ঘঁটে ঘ। সরগরম পরিবেশ, উত্তপ্ত বাদানুবাদ। অনেকটাই শেষ পাতে আমের চাটনির বদলে, লঙ্কারজুস। থমথমে পরিবেশ।
ভোর ৪টে ১৫ মিনিটে ট্রেন। হোটেল থেকে অটোতে মিনিট তিনিকের রাস্তা। প্রায় ২টো আড়াইটে পর্যন্ত সবাই জেগেছিলেন, যে যার ঘরে। তিনটের মধ্যে সবাইকে তৈরি হয়ে থাকার বার্তা দেওয়া হয়েছিল। যে দিয়েছিল, সেই পূর্ণেন্দুই সাড়ে তিনটে পর্যন্ত ঘোড়া বিক্রি করে ঘুমিয়েছে। পল্লবীর ডাকে ঘুম ভেঙেছে।

সময়মতো অটো এসে হাজির, সবাই তৈরি। দফায় দফায় পৌঁছনো হল জগদলপুর স্টেশনে। ১ নম্বর প্লাটফর্মে ট্রেন দাঁড়িয়ে। ট্রেনে উঠেই প্রায় সবাই নিজেদের সিট নিয়ে একটা টানা ঘুম।
এক কথায় ঝালে ঝোল অম্বলে সুপার্ব। নো কনফিউশন। ২০ তারিখ সকাল ৬টা ১৫ কোরাপুট সম্বলেশ্বরী ছুঁয়ে ফেলল হাওড়া স্টেশন। এবার বাড়ি ফেরার পালা। আবার গতানুগতিক জীবন, আর ফের অক্সিজেনের খোঁজে পরবর্তী সফরনামার প্রাক সূচি তৈরি করা।