পশ্চিমবঙ্গের উত্তরে বরফে মোড়া হিমালয়ের কোলে জনপ্রিয় শৈলাবাস দার্জিলিং, কালিম্পং, লাভা, লোলেগাঁও, ঋষপ। দার্জিলিং থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার সূর্যোদয়ের দৃশ্য বহুদিন মনে থাকবে। লাভা, লোলেগাঁও আর ঋষপে শনশনে হাওয়া আর কনকনে ঠান্ডায় দু একটা দিন কাটাতে খারাপ লাগবে না। এসব জায়গার কাছে পীঠে গড়ে উঠেছে নতুন নতুন পর্যটকদের গন্তব্য।
হিমালয়ের পাদদেশে সবুজ চা বাগান আর ঘন অরণ্য নিয়ে অপরূপা ডুয়ার্স। ডুয়ার্সের বুকে বয়ে চলেছে তিস্তা , তোর্সা, জলঢাকা, রায়ডাক, কালজানি, মূর্তি, ডায়না ও জয়ন্তী নদী। জলদাপাড়া, গরুমাড়া, চাপরামাড়ি এই তিন অভয়ারণ্যই ডুয়ার্সে। ওঁরাও, মুন্ডা, রাভা, টোটো প্রভৃতি নানা উপজাতির বাসস্থান ডুয়ার্স।

কালিম্পং, লাভা, লোলেগাঁও, ঋষপ
-কালিম্পঙের একদিকে পাহাড়ের মাথায় সবুজ বাগানে সাজানো দেলো। কালিম্পং শহর থেকে তিন কিলোমিটার। গাড়িতে চড়ে সোজা পৌঁছে যআওয়া যায় সেখানে। ঢালু পাহাড়ের ধাপে ধাপে রংবেরঙের ফুল গাছ রয়েছে। আর আছে কেয়ারি করা সবুজ ঘাসের লন। এসবের একপাশে কাঠের বাংলো বাড়ি। নাম দেলো ট্যুরিস্ট লজ। দেলো পাহাড়ের কিনিরায় ভিউপয়েন্ট রয়েছে।
দেলোর পাহাড় দেখে নামার সময় গ্রাহামস হোম দেখতে যেতে হবে। গত শতাব্দীর শুরুতে স্কটল্যান্ডের সাহেব গ্রাহাম কালিম্পঙে এসে অনাথ আশ্রম গড়ে তোলেন। গ্রাহামস হোমের ডেয়ারি ফার্ম ও চার্চ দেখে দেলো জলাধার বা মেওড়াখোলা জলপ্রকল্প দেখতে যেতে পারেন। এখান থেকে কালিম্পং শহরে জলসরবরাহ করা হয়।
এরপর মঙ্গলধাম। রাস্তা থেকে বাঁয়ে নেমে মন্দিরে পৌঁছনো যায়। কৃষ্ণভক্ত মঙ্গলদাসের নামে এই মন্দিরটিকে উত্সর্গ করা হয়েছে। ফল বাগানে ঘেরা একাধিক চূড়া বিশিষ্ট মন্দিরে শ্রীকৃষ্ণের পুজো হয়। কালিম্পঙের ম্যাক ফার্লেনের চার্চটিও সুন্দর। একাধিক গুম্ফা রয়েছে এখানে। শহর থেকে অল্প দূরে দুরপিন্দারা পাহাড়। সেখানে ১৯৩৭ সালে তৈরি হয়েছিল জংডং পালরি ফোব্রাং গুম্ফা।

গুম্ফার মধ্যে গুরু পদ্মসম্ভবের মূর্তি। দেওয়ালে রঙিন থাংকা এবং ফ্রেস্কো চিত্র রয়েছে। গুম্ফার ওপরতলা থেকে দূরের তুষারশুভ্র হিমালয়ের শৃঙ্গগুলিকে দেখা যায়। এই গুম্ফার কাছেই রয়েছে জেলে পলা ভিউ পয়েন্ট। সেখান থেকে পাহাড় ঢালে মিলিটারিদের গল্ফ কোর্স, পাহাড়ের নীচ দিয়ে বয়ে চলা তিস্তা, রিয়াং, রেলি নদীকে দেখা যায়। ফেরার পথে বাইরে থেকে দেখেতে হবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি বিজড়িত। গৌরীপুর হাউস চিত্রভানু। তাছাড়াও পাইন বিউ নার্সারি, কালীমন্দির দেখে নিতে হবে।
কালিম্পঙের বি এল দিক্ষীত রোডে শান্তিকুঞ্জ নার্সারি কিংবা নাইনথ মাইলে নার্সারি ম্যান্স হেডেন-এ অজস্র অর্কিড ও ক্যাকটাসের সমাহার দেখতে ভুলবেন না। কালিম্পঙের প্রাচীনতম গুম্ফাটি ১৬৯২ খ্রি তৈরি। আর সি মিস্রি রোডে একটু উপরে উঠছে থোংসা গুম্ফায় পৌঁছন যায়। গুম্ফাটি ভুটানিজ মনাস্ট্রি নামে বেশি পরিচিত।
২১৯টি ছোট প্রার্থনাচক্র বা প্রেয়ার হুইল গুম্ফাটিকে চারপাশ থেকে ঘিরে রেখেছে। অন্যদিকে কে ডি প্রধান রোডের কাছে আছে বারপা চোলিং গুম্ফা। শহরের মধ্যে থেকে ৩০ মিনিটের হাঁটাপথে গুম্ফায় পৌঁছন যায়। এই তিব্বতীয় গুম্ফার মধ্যে বুদ্ধের তিনটি মূর্তি রয়েছে। কালিম্পং বেড়ানোর সময় এখানকার নেচার ইন্টারপ্রিটেশন সেন্টারটি অবশ্যই দেখবেন।
কীভাবে যাবেন? – কলকাতা থেকে ট্রেনে নিউজলপাইগুড়ি বা বাসে শিলিগুড়ি পৌঁছতে হবে। শিলিগুড়ির তেনজিং নোরগে বাসস্ট্যান্ড থেকে কালিম্পং যাওয়ার বাস আধ ঘণ্টা অন্তর ছাড়ে। দূরত্ব ৫৮ কিমি। এ ছাড়া সার্ভিস জিপও রয়েছে।

লাভা-
কালিম্পং থেকে গাড়ি ভাড়া করে ৩৪ কিমি দূরে লাভায় পৌঁছনো যায়। কালিম্পং থেকে বাস ও সার্ভিস জিপও যাচ্ছে। ঘন সবুজ গাছপালায় ভরা লাভা একটা পাহাড়ি গ্রাম। বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন অংশ সারাদিনই জমজমাট থাকে। একটি নেমে বাজার ও হাট চত্বর। এই অঞ্চলের মাঝখান দিয়ে এগিয়ে গেছে ঢালু রাস্তা। তার দুপাশে দোকানপাট আর লাভার বেসরকারি হোটেল। পায়ে হেঁটে এ পথ দিয়ে এগোলে পৌঁছন যায় লাভার গুম্ফা চত্বরে। গুম্ফাটি একটি ছোট পাহাড়ের মাথায় অবস্থিত। গুম্ফা চত্বর থেকে দূরের শ্বেতশুভ্র হিমালয় দেখা যায়। টিফিনদাঁড়ার ভিউ পয়েন্ট থেকে দেখা সূর্যোদয় বহুদিন মনে থাকবে।
আপনি কি ভ্রমণের খবর মিস করছেন? আপডেট থাকতে যুক্ত হতে পারেন টেলিগ্রাম চ্যানেলে অথবা হোয়াটস অ্যাপে পিং করতে পারেন 9073503958 নম্বরে
তবে লাভা বেড়াতে যাওয়ার আগে একটা বিষয়ে খেয়াল রাখবেন, এখানে যত হোটেল তার তুলনায় পুজোর সময় বেড়াতে আসা পর্যটকদের সংখ্যা অনেক বেশি হয়। সুতরাং বেড়াতে যাওয়ার আগে হোটেল অবশ্যই বুক করবেন। লাভার উচ্চতা ২১০০ মিটার। লাভার প্রধান দ্রষ্টব্য হল বনবিভাগের নেওড়া ব্যালি নেচার ইন্টারপ্রিটেশন সেন্টার। নেওড়াভ্যালি জাতীয় উদ্যানের নানা ছবি, উদ্ভিদ, বণ্যপ্রাণীর মডেল সাজানো রয়েছে এখানে। লাভা গুম্ফাটি তিব্বতীয় বৌদ্ধদের। সেখানে লামাদের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
এখান থেকে ১৪ কিমি দূরে ঝরনা দেখতে গাড়ি নিয়ে যেতে হবে। তারপর গাড়ি রেখে এক কিমি হাঁটা পথে ছাঙ্গে ফলসে পৌঁছনো যায়। সেখানে প্রায় ১০০ ফুট উঁচু পাহাড়ের গা বেয়ে জলস্রোত নামছে। লাভা থেকে অন্যদিকের রাস্তা গিয়েছে নেওড়া ভ্যালি জাতীয় উদ্যানে, দূরত্ব ১৪ কিমি। এই পর্যন্ত গাড়ি যায়। জায়গার নাম চেদিফেরি। তারপর সেখান থেকে হাঁটাপথে জঙ্গলে ঢুকতে হবে। এই জঙ্গল দর্শনের জন্য অনুমতির প্রয়োজন। লাভায় ফরেস্ট লজ সংলগ্ন অফিস থেকে এই অনুমতিপত্র সংগ্রহ করতে হয়।

ঋষপ-
লাভা থেকে ঋষপ জিপে ১১ কিমি পথ। ঋষপ ছোট্ট একটা পাহাড়ি গ্রাম। উচ্চতা ৪৩১০ মিটার। এখানে একটা দিন থেকে ঋষপের সৌন্দর্য উপভোগ করতে হবে। ঋষপ থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার বরফে ঢাকা শৃঙ্গ যেমন দেখা যায়, তেমনই দেড় কিলোমিটার ট্রেক করে টিফিনদাঁড়া ভিউপয়েন্ট পৌঁছনো যায়। লেপচা গ্রাম ঋষপ থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা ছাড়াও, সিংগালীলা, কাব্রুর তুষারচূড়া দেখা যায়।
লোলেগাঁও-
লাভা থেকে ২৪ কিমি দূরে লোলেগাঁও ধুপি, দেওদার, পাইন গাছে মোড়া আরেকটি পাহাডি গ্রাম। স্থানীয় নাম কাফের। ছোট্ট বাসস্ট্যান্ড তার সামনেই গ্রামের বাজার। বাজার আর বাসস্ট্যান্ডের মাঝখান দিয়ে রাস্তা চলে গেছে হেরিটেজ জহ্গলের দিকে। জঙ্গলের মধ্যে ক্যনোপি ওয়াকের ব্যবস্থা রয়েছে।
রাস্তা বাঁ পাশে হেরিটেজ বনাঞ্চলে নানা প্রজাতির গাছপালা রয়েছে ধুপি, পিপল, কাটুস, খাওলা, পাইন গাছের ওপর দিয়ে উঁচুতে ঝুলন্ত সেতুর মতো দড়ি বাঁধা কাঠের পথ এক গাছের মাথা থেকে অন্য গাছের মাথা ছুঁয়ে চলে গেছে জঙ্গলের দিকে। ওই কাঠের তক্তাবাঁধা পথই ক্যানোপি। বাসস্ট্যান্ড থেকে ৪ কিমি দূরে ঝান্ডিদাঁড়া ভিউপয়েন্ট। জিপ যাচ্ছে ঝান্ডিদাঁড়া থেকে হিমালয় পর্বতমালার কাঞ্চনজঙ্ঘা, শিম্ভো, কাব্রু, জপুনো, পান্ডিম, সিনিয়লচু তুষারশৃঙ্গ দেখা যায়।