পূর্ণেন্দু ব্যানার্জি– লখনউ স্টেশনে নেমেই মালুম হল, একটা বড়সড় বিপত্তি হয়েছে। স্টেশনের বাইরে অটো বা কিছু একটা ধরবো, তার জন্য আগে থেকে টাকাটা গুছিয়ে নিতে চাইছিলাম। কিন্তু প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে বুঝলাম, বটুয়া গায়েব। মাথায় বাজ পড়ল। প্রায় তিন হাজার টাকা আর কয়েকটি ভিডিটিং কার্ড আর কিছু খুচরো পায়সা। ভাগ্য ভালো, বাইরে গেলে। লাইসেন্স, ভোটারকার্ড ও ডেবিট কার্ড, আর বেশ কিছু টাকা অন্য ব্যাগে রাখি, তাই বড় বিপদের থেকে বাঁচা গেল।
কিন্তু তিন হাজার টাকা, কমতো নয়। মেজাজটা পুরো বিগড়ে গেল। স্টেশনের মধ্যেই একটি চায়ের দোকানে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম
-ইঁহা লোকাল থানা কিধর হ্যায়।
-পালটা প্রশ্ন এলো, কিঁউ সাহাব, ক্যায়া হুয়া?
-মেজাজ গরম ছিল বলেই, পাল্টা বলেই ফেললাম, শুনাথা লখনউ নবাবোকা শহর, লেকিন ইঁহা চোরুচক্কা জাদা হ্যায় ক্যায়?
কথা টা শুনেই চায়ের দোকানের কর্মী কাম মালিক হেসে বললেন, জনাব, মুসকুরাইয়ে, আপ লখনউ মে হ্যায়। বলেই এক ভাড় চা বাড়িয়ে দিলেন।
-মুসকুরাইয়ে আপ লখনউ মে হ্যায়। কথাটা শুনে আরও মেজাজটা গরম হল, চা নিয়ে বললাম, মেরা পকেট মার দিয়া, অউর আপ বোলতে হ্যা কি মুসকুরাইয়ে!
-জনাব ইয়ে নবাবো কা শহর হ্যায়।
-হাঁ পাতা চল গয়া, লেকিন মেরা পকেট আভি রো রাহা হ্যায়।
-কথাটা শুনেই ভদ্রলোক, হেসে ফেললেন, আমি ব্যাগ থেকে একশো টাকার নোট বের করে দিলাম। ভদ্রলোক হেসে বললেন, আপ কলকাত্তাসে হ্যায়?
-আমি বললাম হাঁ, কিঁউ? ভদ্রলোক বললেন, পয়সা নেহি চাইয়ে সাহাব, আপকা পিকপকেট হুয়া হ্যায় অউর আপ কলকাত্তাসে হ্যা, হামার নবাবকা দুসরা ঘর। আপ হামারে আপনে হ্যা, কলকাত্তা সে।
-এমন একটা কথা শুনে মাথার ভেতর যে দাবানল ছিল, তা যেন কর্পূরের মতো গায়েব হয়ে গেল। তবু বললাম, আরে রাখ লিজিয়ে।
-ভদ্রলোক বললেন, আরে নেহি জনাব, আভিতো মুসকুরাইয়ে, আপ লখনউ ম্যায় হ্যায়।
হ্যাঁ আমি এমন একটা শহরে এসেছি, যাকে শুধু নবাবের শহরই বলা হয় না, আদব, কায়দা, তহজিব, তালিমের শহরও বলা হয়। নবাব ওয়াজেদ আলি শাহর শহর। সেই ওয়াজেদ আলি শাহ, যাঁর শেষ জীবন কেটেছিল, খাস কলকাতায়। আর লখনউ থেকে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর প্রিয় খানসামা থেকে তেহেজিবের পাঠাশালা। শিল্প, সাহিত্য ধ্রপদী সঙ্গীত, নৃত্যের শহর। মেহমান নাওয়াজির শহর। এই শহরের খানদানি বাসিন্দারা যাই হোক না কেন, সে বিত্তশালী থেকে গরিব, প্রত্যেকের মধ্যেই একটা যেন নবাবি ভাব রয়েছে।
মাত্র ৯ বছরই লখনউতে রাজত্ব করেন তিনি। এই সময় কালে তিনি যেমন শিল্প, স্থাপত্য নির্মাণে বিশেষ নজর দিয়েছিলেন, তেমনই মনোরঞ্জনে তিনি ছিলেন অদ্বিতীয়। প্রায় ৩০০ বেগম ছিল তাঁর। সঙ্গীত, নৃত্যের বিশেষ অনুরাগী নবাব সাহেবের জীবনে বড় যন্ত্রণা ছিল বেগমরাই, ফলে সামান্য খিটখিট হলেই, তালাক দিতেন কথায় কথায়।

ইংরেজরা যখন লখনউ শহর দুরমুস করে ভিতরে ঢুকে পড়েছে। প্রাসাদের অন্দরমহলে ত্রাহি ত্রাহি রব। নবাবের সেনা থেকে অন্তঃপুরের কর্মী মহিলারা পালাচ্ছেন। নবাব সাহেব তখনও সিংহাসনে বসে। অন্দরমহলে ঢুকে ইংরেজ সৈন্য হতবাক। পুরো ফাঁকা অন্তঃপুরে নবাবসাহেব বসে রয়েছে। ইংরেজ সেনা কমান্ডার এসে জিজ্ঞেস করলেন, নবাব সাহেব, আপনার প্রাসাদের সবাই পালিয়েছে, আর আপনি বসে আছেন!
-নবাব তাঁর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে উত্তর দেন, আমি বহুবার চিত্কার করে বলেছি, আমার জুতো কোথায়? সেটা পরিয়ে যে যেখানে খুশি যাও। কিন্তু আমার নির্দেশ কেউ মানেনি। তাই জুতোর অপেক্ষায় বসে আছি।
হ্যাঁ আমি সেই নবাবের গড়েই রয়েছে, লখনউ। এতোটুকু পড়ে বুঝতেই পারছেন এ কেমন ঐতিহাসিক নগর। তাই আপনাদেরও বলছি, মুসকুরাইয়ে জনাব, আপ লখনউকা ইতিহাস পড় রহেঁ হ্যায়। উত্তরপ্রদেশের রাজধানী শহর লখনউ। এ শহরের পাড় দিয়ে বসে চলেছে, গঙ্গার শাখা নদী গোমতী। কথায় বলে, বারাণসী কি সুবাহ অউর, লখনউ কি সাম। এক অতুল্য পরিবেশ।

পুরাণ মতে, সূর্যবংশীয় রাজাদের হাতে এ নগরের গোড়াপত্তন হয়। শ্রীরামচন্দ্রের ভাই লক্ষ্মণকে যৌতুকস্বরূপ দেওয়া হয় এ নগর, তখন নাম ছিল লক্ষ্ণণাবতী। সেই থেকেই নাম লখনউ। ষোড়শ শতকে মোগল সম্রাট আকবরের আমলে মুঘল সাম্রাজ্য ১২টি প্রভিন্সে ভাগ হয়। লখনউ হয়, আয়ুধের সুবেদার শহর। বিজনৌর থেকে এখানকার জায়গিরদার হয়ে এলেন শেখ আবদুর রহিম। প্রাসাদও গড়ে তোলেন পাঁচ তলা মহল্লা। তিনি তৈরি করেন, মচ্ছিভবন দুর্গ। আব্দুর রহিমের সঙ্গেই আসে কিছু পাঠান। তাদেরই হাত ধরে এ নগরে বাণিজ্যের সূত্রপাত।
১৭২২ সালে অযোধ্যা থেকে সুবেদার অর্থাত প্রথম নবাব হলেন বারহান উল মুলক সাদাত আলি কান। এর পর এ নগরের একের পর এক নবাব এসেছেন গেছেন। ১৮৪৭ সালে নবাবের গদিতে বসেন নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে, তিনি প্রচণ্ড অর্থ অপচয় করতেন আর অত্যন্ত অলস ছিলেন। তাঁকে সিংবাসন চ্যুত করা হয়। আর বছরে ১২ হাজার পাউন্ড অনুদান দিয়ে কলকাতায় মেটিয়াবুরুজে পাঠানো হয়।
অন্তিমকালে ফোর্ট উইলিয়মে বন্দিদশায় তাঁর শেষ জীবন কাটে।
১৮৫৭ সালেই লখনউতে সিপাহি বিদ্রোহ চরম রূপ নেয়। সেই কাহিনীরূপই ধরা আছে মুন্সিপ্রেমচাঁদের গল্প শতরঞ্জ কি খিলাড়িতে। পরে এই কাহিনি নিয়ে ছবি করেন বিশ্ববরেণ্য চলচিত্র পরিচালক সত্যজিত্ রায়। তাঁর ছবিতে ধরা পড়ে, ক্ষয়িষ্ণু নবাবি আমলের ছবি। শহরটাকে গাড়ি বা অটো নিয়ে ঘুরে দেখতে পারেন। বড়া ইমামবাড়া, আজাখানা, ভুলভুলাইয়াসহ একাধিক দর্শনীয় স্থান।
ভুলভুলাইয়া– সত্যি এক গোলকধাঁধা। পিলার ছাড়া বিশ্বের বৃহত্তম খিলানাকৃতি হল। , লৌহ ও দারুর কড়িহীন, ইন্টারলকিং প্রথায় ভল্টেড সিলিং। সেরা দেওয়া স্টাকো শৈলার আস্তরণ। প্রায় ৫ হাজার খিলান রয়েছে। এখানে একই মাপের একই রকম দেখতে ৪৮৯টি দরজা রয়েছে। দেওয়াল ফাঁপা থাকার কারণে, এক পাশের শব্দ অন্য পাশে শোনা যায়। এখান থেকেই সেই প্রবাদ জন্ম নেয়। দেওয়ালেরও কান রয়েছে। গাইড ছাড়া ভুলভুলাইয়াতে চলাফেরা করা মুস্কিল।
ভুলভুলাইয়ার পাশাপিশি, ইমামবাড়া, শহিদ মিনার, শাহনাজাফ ইমামবাড়া, সিকন্দরবাগ, বটানিক্যাল গার্ডেন, ছাত্তার মঞ্জিল, স্টেট মিউজিয়াম, বিধানসভা ভবন ঘুরে দেখতে পারেন। আরও একটি ইন্টেরেস্টিং দেখার জায়গা হল রেসিডেন্সি।
রেসিডেন্সি– অযোধ্যার রাজসভার ইংরেজ দূতের বাসের জন্য মহম্মদ আলি শাহর তৈরি। তদানীন্তন ব্রিটিশ রেসিডেন্ট কর্নেল স্লিমান নবাবের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেন। নবাবের অরাজকতার অজুহাত তুলে ক্ষমতা খর্ব করার চেষ্টা চালায়। কিছু চুক্তিতে সায় না মেলায় ছল করে বিলাসিতা ও উদাসীনতার অভিযোগ আনা হয় নবাব ওয়াজেদ আলি শাহকে। সময়টা ১৮৫৬ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি।
১৮৫৭ সালে ১২ মে দেশ জুড়ে সিপাহি বিদ্রোহ শুরু হয়। লখনউতে আঁচ পড়ে ৩১ মে। সারা শহরের ২৯৯৪ জন ব্রিটিশ নাগরিক আশ্রয় নেয় রেসিডেন্সিতে। বেইলি গার্ড গেটের পুবের ট্রেজারি রূপ নেয় অস্ত্রাগারে। রেসিডেন্সিতে একটা অংশ জুড়ে তৈরি হয় হাসপাতাল। নবাবের প্রজারা ক্ষুব্ধ হয়ে ৮৭ দিন ঘেরাও করে রাখে। গোলাগুলি চালানো হয়। রেসিডেন্সিতে আগুন লাগায় ক্ষিপ্ত জনতা।
রেসিডেন্সির ভিতর আহার ও ওষুধের অভাবে ব্রিটিশ নাগরিকদের জীবনহানি ঘটতে থাকে। ২ জুলাই কামানের গোলায় প্রাণ হারান স্যার হেনরি লরেন্স। হাজার দুয়েক ব্রিটিশ নাগরিকের দেহ সমাহিত রয়েছে চার্চ সিমেট্রিতে ও গোমী নদীর তীরে। কামানের গোলার ক্ষতচিহ্ন এখনও রয়েছে গিয়েছে রেসিডেন্সিতে। একই ভাবে রাখা হয়েছে স্মারক হিসেবে।
লখনউতে নবাবি খানা খাজানা-লখনউ গেছেন অথচ নবাবি খানা খাবেন না একি হয়! ভোজন বিলাসীদের কাছে লখনউ এক স্বর্গরাজ্য। নানা রেস্তরাঁ নানা পদের মেনু যেমন রয়েছে, একই পদের নানা স্বাদের ছোঁয়াও মিললে হোটেল রেস্তরাঁয়। বিরিয়ানি, পোলাও বা রুমালি রুটির সঙ্গে মুর্গ মুসল্লম আর কাকোরি কাবাব, শামি কাবাব, বোটি কাবাবের জবাব নেই।
লখনউ উত্তরভারতের প্রাণকেন্দ্র হলেও, দক্ষিণী খাবারও মেলে, চেখে নিন মশালা ধোসা। একদম ভিন্ন স্বাদ। সঙ্গে চেখে নিতে পারেন, কুলফি ও ফালুদা। লখনউ থেকে ৩০ কিমি দূরে মালিহাবাদে গিয়ে পৌঁছলে পড়বেন আমের রাজধানীতে। দশেরি, চৌসার পাশাপাশি নানা জাতের আম মিলবে এখানে।
আশা করি এই তথ্যগুলি আপনাদের ভালো লেগেছে, আরে জনাব একবারতো মুসকুরাইয়ে, লখনউমে হ্যায় আপ। ইয়ে ইনফো শেয়ার কিজিয়ে, থোড়া দোস্তোকে সাথ ভি ইনফো বাটিয়ে, খুশিয়া বাটনেসে বাড়তি হ্যায়।