Breaking News

কেন বাঙালিদের হাতছাড়া হল, পশ্চিমের বাড়িগুলি? ফিরে দেখা কালো অধ্যায় জোশিডি, শিমুলতলার

পূর্ণেন্দু ব্যানার্জি-একটা সময় ছিল বাঙালি বাবুদের হাওয়া বদল বা সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রায় পাড়ি দিতেন বিহার অধুনা ঝাড়খণ্ডের ‌জোশিডিতে। বাংলার প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিকদের কলম হাতড়ালেও, দুমকা, ‌জোশিডি, মধুপুর, শিমুলতলা, গিরিডি এই নামগুলো ঘুরে ফিরে আসে। বর্তমানে সৌখিন মেজাজি বাঙালিদের দ্বিতীয় ঘর ‌যেমন শান্তিনিকেতন, ঠিক তেমনই কয়েক দশক আগেও বাংলার সৌখিন স্বাস্থ্য সচেতন বাবুদের দ্বিতীয় বাড়ি ছিল ‌জোশিডি।

কিন্তু সময়ের গর্ভে তা এখন ইতিহাস। এক সময়ের গর্বের বাংলো বাড়িগুলিও অবহেলা, অ‌যত্নের শিকার। তবে আদি অঙ্গ রাজ্যের অন্তর্গত এই জায়গার জলহাওয়ার ‌যে একটা বড়গুন ছিল, তা এখনও রয়েছে। তাই ফিরে দেখা বাঙালিদের দ্বিতীয় ঘরকে ঘুরে দেখা ‌যায়। আর খোঁজ চালানো ‌যায় এখানকার জলহাওয়ায় কী জাদু রয়েছে।

দু-তিনদিনের সফর সূচি তৈরি করতে চাইলে উইকএন্ডে করে নিতে পারেন, ‌জোশিডি, শিমুলতলা , মধুপুর। সঙ্গে ঘুরে নিতে পারেন দেওঘর। ‌শিমুলতলা নিয়ে আমি বিস্তর ইতিহাসে ‌যাবো না। তবে এক সময় বাঙালির প্রিয় পশ্চিম তথা জোশিডি ও শিমুলতলা কেন মৃতপ্রায় হয়ে উঠলো, তার ইতিহাসের একটা টাইমলাইন দেওয়ার চেষ্টা করবো। বোঝার চেষ্টা করবো কীসের ঘাত প্রতিঘাতে অমৃত জলবায়ুর এলাকা হারিয়ে ‌যেতে বসলো।

ব্রিটিশ সময়কাল থেকেই একটা বাঙালি শ্রেণির উদয় হয়েছিল। তাঁরাও অনেকটাই শৌখিন মেজাজি ছিলেন। বলাই বাহুল্য, কর্ম হোক বা শখে জোশিডি, শিমুলতলায় বাড়ি তৈরি করতে শুরু করেন। মূল উদ্দেশ্য ছিল, স্বাস্থ্যোদ্ধার। কারণ এখানকার জলহাওয়ায় ‌যে একটা ম্যাজিক ছিল বা এখনও রয়েছে, তা বহুবার প্রমাণিত। তবে একটা সময়ে এই জায়গা থেকে কা‌র্যত বাঙালিরা উচ্ছেদ হতে শুরু করে তার মূল কারণ ঝাড়খণ্ড আন্দোলন। আর সময়ের সঙ্গে ‌যত জোরালো, রক্তক্ষয়ী হয়েছে, তত দ্রুত উধাও হয়েছে, বাঙালির পশ্চিমবাস।

এবার দেখা ‌যাক, এই আন্দোলনের ইতিহাসের একটা টাইমলাইন।

১৮৩১-৩২ জমিদারদের বিরুদ্ধে একটা আওয়াজ উঠতে শুরু করে। প্রধানত এই আন্দোলনে প্রত্যক্ষ ‌যোগ দেয় কলকাতার বিপ্লবীরা।

১৮৯৫-১৯০০ বিরসা মুন্ডার নেতৃত্বে ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু হয়। দীর্ঘ পাঁচ বছর চলে গেরিলা লড়াই। সাঁওতাল পরগনা থেকে নিজেদের সরাতে থাকে ব্রিটিশরা। ‌যদিও প্রাণ দেন বহু উপজাতি ভূমিপুত্র।

১৯১৫ গঠন হয়, ছোটনাগপুর উন্নতি সমাজ।

১৯২৮ সিমন কমিশনের কাছে ঝাড়খণ্ড নামক পৃথক রাজ্যে দাবি জানায় ছোটনাগপুর উন্নতি সমাজ।

১৯৩৮ শুরু হয় খারশওয়ান আন্দোলন। এটাই সম্ভবত প্রথম গণ আন্দোলন। এর আগে মূলত জাতিগত আন্দোলন হয়েছে। এই আন্দোলনে ব্যবহার হয় আগ্নেয়াস্ত্র।

১৯৩৯ জয়পাল সিং, তপশিলী জাতিদের প্রধান নেতা বৃহত্তর ঝাড়খণ্ডের দাবি জানায়। এবং আন্দোলন শুরু করে। দাবি ছিল, বাংলা, বিহার, মধ্যপ্রদেশ ও ওডিশা থেকে নেওয়া ২৬টি জেলা নিয়ে গঠন করা হোক ঝাড়খণ্ড।

১৯৪৯ আইন পাস করানো হয়, সাঁওতাল পরগনা টেনেন্সি প্রহাইবিটিং অ্যাক্ট। ‌যেখানে উপজাতিদের জমি অন্য কেউ কিনতে পারবেন না।

১৯৪৯ জয়পাল সিং-এর নেতৃত্বে গঠন হয়, ঝাড়খণ্ড পার্টি এবং আদিবাসী মহাসভা।

১৯৫২ ঝাড়খণ্ড পার্টি প্রাথম সাধারণ নির্বাচনে ৩ টি লোকসভা ও বিহারের ৩১টি বিধানসভা আসন জয় করে।

১৯৫৫ বিহার রাজ্যসরকারের কাছে পৃথক রাজ্যের সনদনামা পেশ হয়। ‌যদিও কমিশন সেটিতে নাকচ করে দেয়।

১৯৫৭ ঝাড়খণ্ড পার্টি ১৯৫২ সালে ‌যে ক্ষমতায় ছিল তা ধরে রাখে এবং দক্ষিণ বিহারে তারা প্রধান বিরোধী শক্তি হিসেবে নিজেদের প্রকাশ করে।

১৯৭২ ঝাড়খণ্ড আন্দোলনে গতি বদলায়। সাঁওতাল নেতা শিবু সোরেন তৈরি করেন ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা। তাঁর পাশে ছিলেন শিবাজী সমাজের বিনোদ বিহারী মাহাতো। এমসিসি (মার্ক্সসিস্ট কো-অর্ডিনেশন কমিটি) র সঙ্গে হাত মিলিয়ে শুরু করেন নতুন ধরার আন্দোলন।

১৯৭৮ দুমকা বিধানসভার আসনটি ছিনিয়ে নেন শিবু সোরেন। এর পরেই কংগ্রেস সাংসদ জ্ঞানরঞ্জন এবং পরে ইন্দিরা গান্ধীর প্রিয় হয়ে ওঠেন শিবু সোরেন।

১৯৮৬ কংগ্রেস সঙ্গে ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার ঘনিষ্টতা দেখে বিরক্ত হয়, দলের একাংশ। তৈরি হয় আর এক দল অল ঝাড়খণ্ড স্টুডেন্টস ইউনিয়ন।

১৯৮৬ সালে রাম দয়াল মুন্ডা ফের আদিবাসীদের সংগঠিত করে আন্দোলন শুরু করেন।

১৯৮৭ রামদয়াল মুন্ডার নেতৃত্বে ঝাড়খণ্ড কো-অর্ডিনেশন কমিটি তৈরি হয় এবং ৪৮টি আদিবাসী সংগঠন ‌যোগ দেয়। তার মধ্যে ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা।

১৯৮৮ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বুটা সিঙের কাছে রামদলায় মুন্ডা ঝাড়খণ্ডের পৃথক রাজ্য নিয়ে রিপোর্ট পেশ করে। দাবি জানানো হয়, বৃহত্তর ঝাড়খণ্ডের জন্য স্বশাসন দেওয়া হোক।

১৯৮৯ সালে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক কমিটি গঠন করে ঝাড়খণ্ড সম্পর্কে। সেখানে তিনটি প্রস্তাব উঠে আসে।

ক) বৃহত্তর ঝাড়খণ্ড গঠন হতে পারে।

খ) কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল হতে পারে।

গ) ঝাড়খণ্ড জেনারেল কাউন্সিল গঠন হতে পারে।

১৯৮৮-৮৯ ঝাড়খণ্ড কো-অর্ডিনেশন কমিটি থেকে বেরিয়ে আসে, ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা এবং অল ঝাড়খণ্ড স্টুডেন্টস ইউনিয়ন। শুরু করে সংগঠিত লাগাতার বন্ধের রাজনীতি। আর এতেই পঙ্গু হতে শুরু করে রাজ্যের আর্থিক ব্যবস্থা।

১৯৮৯ বিজেপি ক্ষমতায় এসে, পৃথক রাজ্যের সমর্থন করে। কিন্তু ১৬টি জেলা নিয়ে বৃহত্তর ঝাড়খণ্ডের দাবিকে তারা সমর্থন করে না।

১৯৯১ ফের জোর আন্দোলন শুরু করে ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা, সাধারণ নির্বাচনে লোকসভায় ৬টি আসন জয় করে।

১৯৯৫ পৃথক রাজ্য না করে তৈরি হল, ঝাড়খণ্ড অঞ্চল স্বশাসন পর্ষদ (JAAC)

২০০০ অবশেষে ১৫ নভেম্বর দেশের ২৮ তম রাজ্য হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ঝাড়খণ্ড।

নতুন রাজ্য গঠন হওয়ার পর, কেটেছে কয়েকটা বছর। এই টাইমলাইনটি দেওয়ার একটাই উদ্দেশ্য। এক সময় বাঙালির প্রিয় জায়গা কীভাবে রাজনৈতিক টানাপোড়েনের শিকার ছিল সেটা তুলে ধরা।

জোসিডির ছবিটা অনেকটাই বদলে গিয়েছে, উঠেছে নতুন ইমারত। কলকাতার উচ্চবিত্ত বাঙালির ইতিহাস প্রায় অনেকটাই হারিয়ে গিয়েছে। বরং শিমুলতলায় এখনও কিছুটা বেঁচে রয়েছে। ‌যদিও কঙ্কালসার চেহারা নিয়ে। ‌যে বাঙালির স্বাস্থ্যোদ্ধারের প্রধান কেন্দ্র ছিল শিমুলতলা, সেই জায়গাই আজ বেহাল স্বাস্থ্যের তকমা পেয়েছে।

কী ভাবে ‌যাবেন? – হাওড়া থেকে ‌যশিডি ‌যাওয়ার বেশ কিছু ট্রেন রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম, রাক্সৌল এক্সপ্রেস, অঙ্গ এক্সপ্রেস, মোকামা প্যাসেঞ্জার।

থাকবেন কোথায়? সস্তায় হোটেল পেতে পারেন জোসিডি বা শিমুলতলায় বেশ কিছু পুরনো বাড়ি আছে সেগুলি ভাড়া করতে পারেন। এ ছাড়া অন্য রিসোর্ট নামে একটি হোটলও রয়েছে। আর যাঁরা দেওঘরে থেকে ঘুরতে চান, ক্লক টাওয়ারের কাছে বেশ কিছু হোটেল রয়েছে।

আমাদের চ্যানেলে যুক্ত হয়ে যান

About Orbit News

Check Also

অযোধ্যার রাম মন্দির: ইতিহাস, কিংবদন্তি ও এক মহামন্দিরের পুনর্জন্ম

অযোধ্যা, যা হিন্দু ধর্মগ্রন্থগুলোর অন্যতম পবিত্র স্থান, ভগবান শ্রীরামের জন্মভূমি হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত। এখানে নির্মিত শ্রীরাম …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!