Breaking News

৭০ বছর ধরে তদন্ত চালানোর পরেও অমীমাংসিত এক মৃত্যু রহস্য

অর্বিট ডেস্ক- একটি রহস্যময় মৃত্যুর তদন্ত কতদিন চলতে পারে! এক বছর, দু বছর, পাঁচ বছর? একটা সময় আসে যখন পুলিশ হার স্বীকার করতে বাধ্য হয়।  ক্রাইম নেভার পে-র মতো প্রবাদ মিথ্যে হতে শুরু করে।

সাধারণত দেখা যায়, একটি সাধারণ মানুষের মৃত্যু রহস্য নিয়ে পাঁচ থেকে সাত বছরের বেশি তদন্ত চালায় না পুলিশ। আর ভি আই পি হলেও একই অবস্থায় থাকে। অথচ অস্ট্রেলিয়ায় একজন সাধারণ নাগরিকের মৃত্যু রহস্যের অনুসন্ধান চলেছিল ৭০ বছর ধরে।  ঘটনা অবাক করার মতো ঘটলেও, ঘটেছিল।

১৯৪৮ সালের ১ ডিসেম্বর। দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার সোমার্টন সমুদ্র সৈকতের কাছে এক অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তির দেহ উদ্ধার করে পুলিশ। দেহটি সৈতকের পাশে একটি পাঁচিলে হেলানো ছিল।  পুলিশ দেহটিকে উদ্ধারের পর কবরস্থ করার জন্য কফিন আনানোর ব্যবস্থা করে। সেই সময়ই, দেহ ও তার জামাকাপড় থেকে উদ্ধার হওয়া জিনিসপত্র বাজেয়াপ্ত করে তদন্ত শুরু করে। পুলিশের কাছে প্রথম চ্যালেঞ্জ ছিল, মৃতদেহটি শনাক্ত করার।

কারণ দেহ শনাক্ত করতে পারলেই, পরবর্তী তদন্তে অগ্রগতি পায়।  পুলিশ জামাকাপড় পরীক্ষা করে, কিছু মুদ্রা, একটি ট্রেনের টিকিট, একটি বাসের টিকিট, সাতটি বিভিন্ন কোম্পানির সিগারেট ও একটি কাগজের টুকরো পায়। সেই কাগজটি ছিল একটি বইয়ের শেষ পাতার অংশ।  সেখানে ফারসি ভাষায় লেখা ছিল তামাম সুদ্ধ-। অর্থাত্ সমাপ্ত। যেভাবে একটি বইয়ের শেষে লেখা থাকে সমাপ্ত, দ্যা এন্ড, তেমনই। এ ছাড়া কোনও পরিচয়পত্র ছিল না।

পুলিশ তদন্তে জানতে পারে, যে বই থেকে এই পাতা ছেঁড়া হয়েছিল, সেটি ছিল উমর খৈয়ামের লেখা, উমর খৈয়াম কি রুবাইয়ত।  পুলিশ এই বইয়ের কোনও সূত্র বের করতে পারেনি। ময়নাতদন্ত রিপোর্ট হাতে আসার পর, পুলিশ আরও ধন্ধে পড়ে। অনুমান ছিল, অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির বিষক্রিয়ায় মৃত্যু হয়েছে। ময়নাতদন্তের রিপোর্টেও এমন কথা স্বীকার করলেও, সেটি ঘুমের ওষুধ ছিল না, কোনও ভয়ঙ্কর বিষ ছিল, তা পরিষ্কার করে বলতে পারেনি।

১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৯ অ্যাডিলেড রেল স্টেশনের এক কর্মী পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে।  তিনি পুলিশকে জানান, ৩০ নভেম্বর এক ব্যক্তি তাদের লক রুমে একটি স্যুটকেস রেখেছিলেন, কিন্তু সেই ব্যক্তি তা আর সংগ্রাহ করেননি।

পুলিশ রেলের ক্লকরুম থেকে স্যুইটকেসটিকে বাজেয়াপ্ত করে। সেখান থেকে উদ্ধার হয়, একটি, ছুরি, দুটি কাঁচি, সেভিং কিট, এবং একটি কাপড়ের কার্ড। সেই কাপড়ের কার্ডে লেখা ছিল টি কেনি। মনে করা হয়, সৈকতে উদ্ধার হওয়া ব্যক্তির নাম টি কেনি, সেই মতো তদন্ত এগোলেও, পুলিশের হাতে কিছুই আসেনি।

মৃতদেহ ও স্টেশ থেকে পাওয়া জিনিসপত্র উদ্ধার করে পুলিশ একটা থিওরি দাঁড় করায়, সেটি হল, ভদ্রলোক স্টেশনে নেমে, জিনিসপত্র ক্লকরুমে রেখে, সিটিবাস ধরে, কোথাও বা কারও খোঁজে বেরিয়েছিলেন।  

এই তত্ত্ব দাঁড় করানোর সময়ই তাদের নজরে আসে, যে লোক ট্রেন বাসে করে প্রায় সারা শহর ঘুরেছে, সমুদ্র সৈকত এলাকায় ঘোরাঘুরি করেছে, তার জুতো নোংরা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মৃত ব্যক্তির জুতো ছিল পরিষ্কার।  তাহলে কি ওই ব্যক্তিকে অন্য কোথাও হত্যা করে , সৈকত এলাকায় ফেলা হয়েছিল? তদন্ত যত এগোতে থাকে, ততই অন্ধকার আর হাজার প্রশ্ন ভিড় করতে থাকে।

পুলিশ এবার ছেঁড়া পাতার অংশের সূত্র ধরে তদন্ত শুরু করে। সংবাদ মাধ্যমে পাতার ছেঁড়া অংশ ছাপানো হয়, আবেদন করা হয়, যাঁর কাছে এমন ছেঁড়া পাতার উমর খৈয়ামের বই রয়েছে, তারা যেন পুলিশকে সাহায্য করেন।

প্রায় মাস খানেক বাদে ফ্রান্সিস নামে এক ব্যক্তি পুলিশকে ফোনে জানায়, যে বই পুলিশ খুঁজছে, সেই সম্পর্কে তথ্য দিতে পারবে। পুলিশ ফ্রান্সের কাছে গিয়ে বইটিকে উদ্ধার করে, দেখা যায় বইটির শেষ পাতা ছেঁড়া ছিল।

পুলিশ বইটির সঙ্গে পাতার ছেঁড়া অংশ মেলাতেই উত্তর মেলে, বোঝা যায়, এই সেই বই, যার পাতার অংশ ছিল মৃত ব্যক্তির পকেটে। এখানে সূত্র মিললেও, পুলিশের কাছে আরও এক হেঁয়ালির জন্ম দিল। কারণ বইয়ের শেষ পৃষ্ঠায় লেখা ছিল, দুটি ফোন নম্বর ও একটি কোড মেসেজ।

পুলিশে ফ্রান্সিসের কাছে জানতে চায়, এই বই সে কোথায় পেয়েছে, উত্তরে ফ্লান্সিস জানা, একবার রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় একটি গাড়ি সে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, সেখানে কেউ ছিল না, আর পিছনের সিটে এই বইটি দেখে সে তুলে নেয়।

বইয়ের কোড মেসেজ ডিকোড করার চেষ্টা করা হয়, কিন্তু অসফল হয় অফিসারেরা। সেখানে দেওয়া দুটি ফোন নম্বরে খোঁজ করা হলে, জানা যায়, একটি নম্বর জেসিকা থমসন নামে এক মহিলার। আর অন্য নম্বরটির কোনও অস্তিত্ব নেই।

জেসিকা থমসন ছিলেন পেশায় নার্স, তাঁকে মৃত ব্যক্তির ছবি দেখানো হয়, কিন্তু তিনি চিনতে অস্বীকার করেন।  পাশাপাশি তিনি জানান, বইয়ের শেষ পাতায় তাঁর নম্বর কী করে এলো, বা কে লিখেছিল, তাও তিনি জানেন না।

মহিলা আরও জানান, এমন একটি বই তিনি অনেকদিন আগে তাঁর এক বয়ফ্রেন্ডকে দিয়েছিলেন, তাঁর নাম বক্সল। তবে তাঁর সঙ্গে দীর্ঘদিন যোগাযোগ নেই, তাই সে সম্পর্কে নতুন করে তথ্য দেওয়া সম্ভব নয়। পুলিশ মনে করে, মৃত ব্যক্তি হয়তো বক্সল। কিন্তু মহিলা সাফা জানান, বক্স অন্য ব্যক্তি, মৃত ব্যক্তির সঙ্গে কোনও মিল নেই।

পুলিশ খোঁজ তল্লাশির পর বক্সলের সন্ধান পায়।  বক্সলও পুলিশের কাছে স্বীকার করে, এই বইটি জেসিকা তাঁকে গিফ্ট করেছিল।  তবে মৃত ব্যক্তি সম্পর্কে কোনও তথ্য যেমন দিতে পারেনি, বইয়ের ছেঁড়া অংশ নিয়েও নতুন কোনও তথ্য দিতে পারেনি বক্সল।

বেশ কয়েক মাস তদন্ত চালিয়ে, পাকাপোক্ত কোনও সূত্র পায়নি পুলিশ আর পরিচয়ও জানতে পারেনি। অগত্যা তার দেহ কবরস্থ করা হয়।

সময় গড়ায় প্রায় কয়েক দশক বাদে পুলিশের কাছে একটি ফোন আসে, সেই অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তির মৃতদেহকে ঘিরে। ফোনের ওপার থেকে দাবি করা হয়, জেসিকা থমসনের এক পুত্র রয়েছে, যাঁর সঙ্গে ওই মৃত ব্যক্তির ছবির সঙ্গে মিল রয়েছে।  সেই ব্যক্তি আরও দাবি করে, ওই মৃত ব্যক্তি এক বিরল রোগে আক্রান্ত ছিলেন, এবং জেসিকার পুত্র সন্তানও একই বিরল রোগে আক্রান্ত।

পুলিশ এমন একটি তথ্য পাওয়ার পর আবার ফাইল ওপেন করে। জেসিকার সন্তানের ডি এন এ টেস্ট করানোর আবেদন করানো হয়। কিন্তু আদালত পুলিশের সেই আবেদন খারিজ করে দেয়।

অবশেষে ২০১৮ সালে অ্যাডিলেড পুলিশ এই ফাইল ব্লাইন্ড কেস হিসেবে বন্ধ করে দেয়। যদিও তদন্তকারীদের একাংশের দাবি ছিল, যদি জেসিকার সন্তানের ডি এন এ করানো যেত তাহলে অনেক প্রশ্নের উত্তর মিলত। কিন্তু জেসিকার পরিবারের তরফে আপত্তি থাকায় আদালত তা খারিজ করে।

আমাদের চ্যানেলে যুক্ত হয়ে যান

About Orbit News

Check Also

বালির আয়ুং নদীর রক স্কাল্পচার: এক ঐতিহ্যের গল্প

ইন্দোনেশিয়ার বালি দ্বীপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সমৃদ্ধ সংস্কৃতি এবং প্রাচীন ইতিহাসের এক অপূর্ব মিশ্রণ। এই দ্বীপের …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!