Breaking News

জীবনের কিছু কাহিনি অসমাপ্তই থাকে- কুয়াশা যখন

পূর্ণেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়- অ্যালার্মটা দেওয়াই ছিল। দুপুর তিনটে নাগাদ ‌যেন প্রবল জার্কে বেজে উঠল ঘড়িটা। সামান্য আচ্ছন্নে জড়ানো চোখদুটো কেমন ‌যেন স্বপ্নের জগত থেকে ফিরে এল এক লহমায়। জিরিয়ে নেওয়ার পালা শেষ। গুছিয়ে নেওয়া জিনিসগুলিকে আরও একবার ভাল করে মিলিয়ে নিলাম। সন্ধে ৭ টা ৪৫ মিনিটে ট্রেন। কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেস।

বড্ড ঘিঞ্জি স্টেশন শিয়ালদহ। চারপাশে এত বেশি চিৎকারে রীতিমত মাথা ব্যথা ধরে গেল। স্টেশনে এক ঘণ্টা আগে পৌঁছে ‌যাওয়ায় একটু অস্বস্তিতেই পড়লাম। ওই চিৎকারের আওয়াজ থেকে মুক্তি পেতে বার বার ঘড়ির দিকে তাকাতে লাগলাম। আর দেখতে লাগলাম চারপাশে বিভিন্ন চরিত্রের আনাগোনা। কিছুটা ‌যেন হারিয়ে গেলাম নিজের খেয়ালে। খানিক বাদে ট্রেনের তীব্র আওয়াজে ঘোর কাটল।

৩-এ প্ল্যাটফর্মে তখন চূড়ান্ত ব্যস্ততা চার্ট খোঁজার। কোনও ভাবে অনেক ‌যাত্রীর ফাঁক দিয়ে মাথা গলিয়ে নিজের বার্থ নম্বর টা জেনেই স্বস্তি। ট্রেন ছাড়ল। ডিসেম্বর মাস হলেও সেভাবে ঠাণ্ডা লাগছিল না। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের স্তর জমে ‌যাচ্ছিল খুব তাড়াতাড়ি। ট্রেন কিছুক্ষণ চলার পর বাইরের ঠাণ্ডা বাতাস বিন্দু ঘামের সেই ক্লান্তি মুছে দিল দ্রুত।

ট্রেন চলল দুরন্ত গতিতে। সাইড বার্থ থেকে কোলাহল ভেসে আসছিল। সেই দিকে নজর ফেরাতেই আটকে গেল চোখ। একদল ট্যুরিস্ট ‌যাচ্ছেন দার্জিলিং। তাঁদের নানা অভিজ্ঞতার কথা, অনেকটা রাস্তা জুড়েই আমার জন্য বিশেষ মনোরঞ্জকের ভূমিকা পালন করল। বুঝলাম, নানা চরিত্রের মেলা বসেছে এই চলমান ছাদের তলায়।

রাত বাড়তেই ঠাণ্ডা ‌যেন আর হাড়কেও ক্ষমা করছিল না। অগত্যা জানালা বন্ধ করে ঘরের তৈরি কিছু খাবার খেয়ে শুয়ে পড়লাম।

সকাল ৭ টা । হকারদের প্রবল চিৎকারে ঘুমটা ভাঙল। এক হকার কে জিজ্ঞেস করলাম, এন‌জেপি আর কত দূর? উত্তর এল ট্রেন প্রায় ঠিক সময়েই চলছে , আর আধঘণ্টা। হাত মুখ ধুয়ে কিছু খাবার খেয়ে নিলাম।

২।

ডিসেম্বরের শীতের সকালটা ‌যেন বেশি মাত্রাতেই হিমশীতল। সমতলের বাসিন্দা হওয়ার এই একটা সমস্যা। হোটেলের পাশেই রেস্তোরাঁ। ব্রেকফাস্ট সেরে টেবিলে বসে বেশ কিছুক্ষণ কাগজের হেডলাইনে চোখ বোলাচ্ছিলাম। হঠাৎই চোখ গেল একটা ‌টেবিলের কোনার দিকে। বসে এক বিদেশিনী। মুখটা কেন জানি না, বেশ চেনা চেনা লাগছিল। মন বলছে ‌যেন রাশিয়ার ওলগা ! কয়েক বছর আগে ইন্টারনেটে পরিচয় । বেশ একটা বন্ধুত্বও তৈরি হয়েছিল। কিন্তু তার পর হঠাৎ আর ‌যোগা‌যোগ হয়ে ওঠেনি। কালক্ষেপ না করে এগিয়ে গেলাম ওর দিকে।

নিজের পরিচয় দিতে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই চিনতে পারল ও আমায়। চোখের সামনে দু’জন দু’জনকে দেখে কিছুটা বিস্মিতই হয়েছিলাম। কেউই ভাবতে পারিনি পরিচয়ের গল্পটা এভাবে আবার নতুন করে শুরু হবে। আরও এক রাউন্ড কফির অর্ডার দিয়ে আমাদের গল্প চলল বেশ খানিক্ষণ । জানতে পারলাম, একটি এন জি ও সংস্থার কাজে সে কলকাতায় এসেছে, কাজের ফাঁকে, আশে পাশের জায়গা গুলোও দেখে নিতে চায়-।

পাশেই হাঁটছিল ওলগা । এই হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডায়, অদ্ভুত স্বচ্ছন্দ লাগছিল ওকে । রাশিয়ার ইরকুর্টসক-এর বাসিন্দা হওয়ার কারণেই বোধ হয়। হোটেল থেকে প্রায় ৬ কিলোমিটার পথ কার্শিয়ং ডিয়ার পার্ক। আঁকা বাঁকা খাড়া পথ ধরে মাঝে মাঝেই কিছু গাড়ি উঠছে আর নামছে। বেশ কিছুক্ষণ হাঁটতে হাঁটতে কেমন ‌যেন হাঁফিয়ে উঠছিলাম।

কখনও অল্প বিরাম আর ডিজিটাল ক্যামেরায় বন্দি করছিলাম প্রকৃতির অনবদ্য রূপের ফ্রেম। ডিয়ার পার্কে ‌যাওয়ার রাস্তা থেকেও কাঞ্চণজঙ্ঘা দেখা ‌যায়। তবে এই সময়টা সেই আদর্শ সময় নয়। ভাগ্যে থাকলে অবশ্য দেখা ‌মেলে সেই অপূর্ব কন্যার সূর্যস্নানের দৃশ্য। পাহাড়ের গা বেয়ে লম্বা লম্বা পাইন আর ফার্নের গাছ। তার মাঝেই কুয়াশার লুকোচুরি। ওলগা ‌যে এই দৃশ্যের মহিমায় হারিয়ে গিয়েছে, তা খেয়াল করলাম বেশ খানিক্ষণ পর। চড়াই পাকা রাস্তার মাঝে কেবল হাওয়ার সন্ সন্‌ আওয়াজ। নিস্তব্ধতার বিচরণের মাঝে কেবল কুয়াশার লুকোচুরি।

ঠাণ্ডা থাকলেও কানের পাশে, কপালে তখন বিন্দু বিন্দু ঘামের আভা জমেছে। কিছুটা জিরোনোর কারণেই দাঁড়ালাম একটি ছোট্ট দোকানে । জল চাইতেই হাসি মুখে হাত বাড়িয়ে দিলেন দোকানের মালিক। ভদ্রলোক স্থানীয়। কিছুটা সৌজন্য বশতই দু প্যাকেট বাদাম কিনলাম। ওলগা কিছু একটা খুঁজে চলেছে আনমনে। সূর্যের তেজ না থাকলেও হালকা গরম লাগছিল এবার।

কিছু পাখির আওয়াজ ‌যেন নিস্তব্ধতার পার্শ্ব সঙ্গীত। উত্তর দিকেই চোখ রেখে চলেছিল ওলগা। বেশ খানিকটা পথ সংলাপহীন চলার পর অগত্যা জিজ্ঞাসাই করলাম ওলগাকে “কী খুঁজছো?” কয়েক সেকেন্ড বাদে উত্তর এল, “কাঞ্চনজঙ্ঘাকে।” আমি বললাম, “আজ কুয়াশার ভার বেশি, আকাশে ঘন মেঘও রয়েছে, ওই পর্বতচূড়ার দেখা পাওয়া মুশকিল।” আমার দিকে ঘুরে সে বলল, “আমার মন বলছে, এ মেঘ সরবেই, কাঞ্চনজঙ্ঘার দেখা পাবই।” ওলগার হাল্কা সবুজ চোখে দেখেছিলাম, অফুরন্ত আত্মবিশ্বাস , সঙ্গে কিসের ‌যেন চাপা মেঘ।

যতই ওপরে উঠছি ততটাই ‌যেন গরমটা ‌যেন জড়িয়ে ধরছে। ‌জ্যাকেট, শোয়েটার খুলে ফেলতে ইচ্ছে করলেও উপায় নেই । কারণ ঘড়ির সঙ্গেই লাগানো ডিজিটাল থার্মোমিটারে দেখলাম তখনও আমাদের আশেপাশের তাপমাত্রা ৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। নিজের খেয়ালে ওলগা। হঠাৎই সে থমকে দাঁড়িয়ে কিছুটা চিৎকারের সুরেই জিজ্ঞাসা করল, “ওটা কোন পাখির আওয়াজ?” একটা পাখির ডাক আসছিল বটে কিন্তু কী পাখি আমার তা জানা ছিল না।

অগত্যা বলতেই হল “জানি না।” খানিকটা ব্যঙ্গ্যের সুরেই সে আমাকে বলল, “আসলে , আসলে তোমরা চিনতে চাও না, জানতে চাও না।” তোমরা ‌যা হাতের সামনে পাও তার মূল্য দিতে পার না।” অদ্ভুত হেঁয়ালিটা বুঝলাম না। কী কারণে বলল তা পাল্টা জিজ্ঞাসা করার সাহস হল না। আর কয়েক কদম এগোলেই ডিয়ার পার্ক। দূর থেকেই দেখা ‌যাচ্ছে বহু পর্যটক ‌ভিড় জমিয়েছে পার্কে। কয়েকটা ছবি তুলেই একটা কংক্রিটের চেয়ারে বসে পড়ল ওলগা। আমিও পাশেই বসলাম। এমন উদাস হতে ওকে একবারও দেখিনি আজ। প্রায় জোর দিয়েই জিজ্ঞেস করলাম। “কী হয়েছে?” কোনও উত্তর এলনা ।আবারও বললাম, “কোনও সমস্যা?” এবারও কোনও উত্তর দিল না সে। আমি ওর সবুজ চোখ দুটোর দিকে বেশ খানিক্ষণ তাকিয়েছিলাম।

৩।

প্রায় ঘণ্টা দুয়েক কাটল একসঙ্গে। রাত তখন প্রায় সাড়ে ৮ টা। চারপাশে এতটাই কুয়াশা ‌যে, ১০ ফুট দূরের কোনও বস্তুর নজর করা মুশকিল। রাস্তায় গুটিকয়েক লোক। ছোট্ট কার্শিয়ং স্টেশনে বসে কত কিছুই না মনে এল গেল। চারপাশের আলো আঁধারি পরিবেশ অনেক্ষণ পরে মুখ ফোটাল ওলগার। সে বলল, “আজ একটা কথা খুব বলতে ইচ্ছে করছে, জানি না কেন। শুনবে?” আমি এক মুহূর্ত সময় না নিয়ে বলে উঠলাম, “কেন শুনব না?” কয়েক সেকেন্ড চুপ থাকার পর সে শুরু করল।

“সময়টা ২০০৮। কয়েকজন বন্ধু মিলে ঠিক করলাম, অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরে ‌যাব। প্ল্যানটা ছিল আমার, তবে প্রথম থেকেই রাজি ছিল গুলনারা, এলেনা, আফানসি, আর ভ্লাদিসলাভ। সনিয়া আর বোরিস প্রথমে রাজি না হলেও বন্ধুত্বের খাতিরে রাজি হয়ে ‌যায় পরে। অবশ্য তাদের ট্যুরে ‌যাওয়া নিয়ে কোনও সমস্যা ছিল না। এর আগেও বেশ কয়েক জায়গায় গিয়েছিলাম আমরা কজন। আপত্তি ছিল ‌যাওয়ার জায়গাটি নিয়ে। ওমিয়াকোন, উত্তর সাইবেরিয়ার প্রত্যন্ত একটি গ্রাম। অনেকেই বলেন, কোনও কিছু দুর্ঘটনা ঘটার আগে একটি অশনি সঙ্কেত পাওয়া ‌যায়। আমাদের ক্ষেত্রে তেমন কিছু হয়নি। সব কিছু ঠিক ঠাকই ছিল।

বেশ মনে আছে ৪ জুন আমরা সাতজনে ইরকুর্টসক থেকে উঠলাম ট্রেনে। প্রায় ৪ হাজার কিলোমিটার রাস্তা। চার দিনের সফর। কয়েকশো কিলোমিটার পর পর গড়ে ওঠা জনপদ। চারপাশে বরফের চাদরে মোড়া গাছ গাছালি। নামলাম ইয়াকুটসক-এ। স্টেশনে নেমেই বুঝলাম ঠাণ্ডার পারদ কোন তলানিতে নেমেছে। ট্রেনের ট্র্যাকের উপরে জমে পুরু বরফের চাদর। রেল কর্মীরা বেলচা দিয়ে চাকায় লেগে থাকা বরফ পরিষ্কার করতে ব্যস্ত।

ডিজিটাল থার্মোমিটার দেখে জানতে পারলাম, তাপমাত্রা -১৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। এখানেই আমাদের ‌যাত্রার শেষ ছিল না। একটি গাড়ি ভাড়া করে চললাম ওমিয়াকোনের পথে। এমন অ্যাডভেঞ্চারাস ট্যুরে এর আগে কখনও ‌যাইনি। ড্রাইভারের কাছে জানতে পারলাম ওমিয়াকোনে এতটাই ঠাণ্ডা পড়ে, বহু পর্যটক ‌যেতেই পারেন না। গেলেও থাকতে পারেন না। গুটিকয়েক গ্রামবাসী নিরুপায় হয়েই থাকেন।

সেখানে রাত কাটানোটাই ছিল আমাদের রোমাঞ্চ। জানি না কার নজর লেগেছিল সেদিন। দুপুর থেকে মেঘের চাদর মুড়ে ছিল আকাশকে। সনিয়ার শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। বোরিস ব্যস্ত ছিল ওকে নিয়ে। স্থানীয় বাসিন্দাদের সেবায় বিকেলের দিকে কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠল সনিয়া। সন্ধে নামল। স্থানীয় একজনের বাড়িতে আলাদা আলাদা ঘরে ছিলাম আমরা। সবাই আমরা ওয়াইন খেয়েছিলাম। কারণ, ঠাণ্ডা, প্রচণ্ড ঠাণ্ডা।”

আঁধার বাড়লেও কার্শিয়ং স্টেশনের পরিবেশ অনেকটাই পরিষ্কার। আকাশের চাঁদকে আবছা আলোয় দেখা ‌যায়। ধীরে ধীরে পরিষ্কার হচ্ছে মেঘ । প্রকৃতি জানান দিল , রাত ‌যত বাড়বে প্রকৃতি আরও পরিষ্কার হবে। ‌যেমন অনেকটা ওলগার মন। কথা বলতে বলতে লম্বা শ্বাস নিল ওলগা, আকাশের দিকে চেয়ে। আবছা আলোয় স্পষ্ট দেখা ‌যাচ্ছিল তার চোখের জল। “তীব্র ঠাণ্ডার চোটেই ঘুম ভেঙেছিল আমাদের।

এলেনার ‌সঙ্গে একই ঘরে শুয়েছিল সনিয়া। এলেনা ‌যখন আমাদের ঘরে এল, তার চোখে মুখে দেখেছিলাম অদ্ভুত এক ভয়ের অভিব্যক্তি। তীব্র আর্তনাদ ছিল তার চোখে, কিন্তু মুখে কোনও আওয়াজ শুনতে পাই নি আমরা। প্রবল ভাবে বলতে চাওয়ার সেই অব্যক্ত আর্তি আজও দুঃস্বপ্নে হানা দেয়। সে স্বপ্ন দেখলে কয়েক রাত ঘুম আসে না আজও। বেশ কয়েক মিনিট পরে জেনেছিলাম সনিয়া আর নেই। বোরিস খুব চোট পেয়েছিল মনে। আজও সে মস্কোর এক অ্যাসাইলামে চিকিৎসাধীন। আমি এ সব কিছু ভুলতে চাই ; কিন্তু পারি না। জানি না কেন !”

৪।

রাত আরও বাড়ল। আশেপাশের রাস্তা, স্টেশন চত্বর পুরো ফাঁকা। ঠাণ্ডার কারণেই রাস্তার সারমেয়রাও বিদায় নিয়েছে। একটি রেলিং-এ বসে আমরা দু’জনে। আর চাঁদের আলো অন্য অভিসারে। শোয়েটারের গায়ে তখন বিন্দু বিন্দু হিম নিঃশব্দে বাসা জমিয়েছে। বেশ কিছুটা সময় কাটল নিস্তব্ধতার সঙ্গে।

মেঘ পরিষ্কার হলেও হয়তো বাকি ছিল কুয়াশার দমকা হাওয়া। হয়তো দীর্ঘ অপেক্ষার সেই দমকা হাওয়া । – “আমি ভাল বাসতে চাই। তোমাকে নিজের মত করে পেতে চাই। কিন্তু কী করে পাব? আমি কেন গভীর ভাবে দেখলাম তোমায় কার্শিয়ং ? তোমার এ রহস্যময়ী জীবনের জট আমি কী ভাবে খুলব আমি জানি না। তোমার এই রূপ দিয়ে ‌কেন আমার ভুলতে বসা জীবনের কথা আবার তুলে ধরলে? কেন?” কিছুটা পাগলের মতই বকে ‌যাচ্ছিল ওলগা। তার চোখে কান্না ছিল না, ছিল জমাট কুহেলি।

এ ‌যেন এক অন্য রাতের গল্প। কিছু কাছে পাওয়ার রাত, কিছুটা হারিয়ে ‌যাওয়ারও। ওলগার সবুজ চোখের কোনায় চাঁদের বাসা। স্পষ্ট ক্ষতের দাগ। চারপাশে ‌যেন অদ্ভুত নিস্তব্ধতার কনসার্ট। আকাশ থেকে মাথা নীচু করল ওলগা। অন্ধকার মায়াময় পথ ধরে ধীর লয়ে হাঁটতে লাগল সে। মাত্র কয়েক মিটার দূর থেকেই আর তার অবয়ব চোখে পড়ল না। স্টেশনের রেলিংয়ে কিছুটা অসাড় দেহ নিয়েই বসে রইলাম। অনেক্ষণ। কত ভাবনা এল গেল।রজনীর গর্ভে বসে অগুনতি স্বপ্নের জাল ছিঁড়ে আসতে পারিনি আমি। আকাশের উজ্জ্বল তারা গুলো কেমন মিলিয়ে ‌যাচ্ছিল মেঘের অন্তরালে।

তখনও অন্ধকারের রেশ একদমই কাটেনি। কিন্তু কিছু পাখির সুরেলা ‌ডাক জানিয়ে দিল, সূর্যের নতুন উদয় হতে আর বেশি বাকি নেই। ভোর চারটে। নিদ্রিত কার্শিয়ংয়ের অন্তরালেই চলল অনেক কিছু। অন্ধকারের বুক চিরে আমিও চললাম হোটেলে। নতুন সূর্য উদয়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছুই বদলে ‌যাবে এই আশায়।

৫।

অন্ধকার ঘরে চোখ বন্ধ করে থাকলেও ঘুম এল না। মোবাইলের অ্যালার্মে চোখের পাতা খুলল। সকাল ৮ টা। শুরু হয়ে গিয়েছে কার্শিয়ংয়ের ধীর গতির জীবন। হোটেলের জানালার বাইরে চোখ পড়তেই নজরে এল মনোরম পরিবেশ। আজকের মেঘ অনেকটাই পরিষ্কার। ভাবলাম আজ হয়ত কাঞ্চনজঙ্ঘাকে দেখা ‌যাবে। সেই আশায় মুখ বাড়ালাম জানালার বাইরে। ঘরের কলিং বেল টা বেজে উঠল। দরজা খুলতেই হোটেলের বয় আমার হাতে ভাঁজ করা একটি কাগজ দিয়ে চলে গেল। একটি চিঠি। ভাঙাচোরা ইংরাজিতে তাতে লেখা ছিল কিছু কথা। ‌যার সারমর্ম হল –

প্রিয় বন্ধু,

আমার কোথাও ভাল লাগছে না। কেমন ‌যেন একটা চাপা কালো মেঘ বারবার আমার বলয়কে চেপে ধরে। কোথাও সেই মেঘ ছেড়ে লুকিয়েও পালাতে পারি না। ‌যেখানেই ‌যাই, সেই মেঘ এসে ধরে। ভেবেছিলাম তোমার সঙ্গেই থেকে ‌যাব। আমার ভাল লেগেছে কার্শিয়ংকে, কিন্তু ভুলতে চাই তাকে। চিরকালের জন্য। হয়ত পারব না। তবু ভুলতে চাই। এই কার্শিয়ংকে। আমাকে ভুল বুঝো না। আমার আচরণ, আগোছালো কথা পাগলামি মনে হলে, ক্ষমা করে দিও। আমি দেশে ফিরতে চাই। চললাম।

তোমার প্রিয়,

ওলগা

কলকাতায় ফিরে বেশ কয়েকদিন পর একটা মেল পাঠালাম ওলগাকে। কয়েক সেকেন্ড পরেই উত্তর এল, ‘ডেলিভারি টু দ্য ফলোয়িং রেসিপেন্ট ফেইলড্ পারমানেন্টলি।’

অনেক কিছু জানার ছিল ওলগার কাছে। জানা হল না। একটি সম্পর্কের এ ভাবে মৃত্যু হবে তা কি ভগবানও জানতেন ? জানি না । কার্শিয়ং তুমি কি জান?

আমাদের চ্যানেলে যুক্ত হয়ে যান

About Orbit News

Check Also

জীবনে কিছু সফরের সঙ্গে জুড়ে যায় অলৌকিক ঘটনা, তা নিয়েই এক রহস্যময় কাহিনি

বারাণসীতে আমি ও সেই মেয়েটা পূর্ণেন্দু ব্যানার্জি ২০১০, ১৬ নভেম্বর। আমার প্রথম বারাণসী ‌যাত্রা। কিন্তু …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!