স্বাতী চ্যাটার্জি– টোকিও থেকে প্রায় ১৩৮ কিলোমিটার পথ ফুজিনোমিয়া। ঝাঁ চকচকে রাজপথ। গাড়িতে সময় লাগে প্রায় দু ঘণ্টা। যেন এক আশ্চর্যনগর। মন ভালো করে দেওয়ার শহর। পরিবেশ দূষণ নেই বললেই চলে। শান্ত, স্নিগ্ধ মনোরম পরিবেশ সেই সঙ্গে গাড়ির নিজস্বছন্দে পথ চলতে কখন যে সময় কাটে কেউ বলতে পারে না।
ফুজিনোমিয়া শহর থেকেই দেখা যায়, ফুজি পর্বতকে। এই শহর থেকে ১৩৯ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে চলে যাওয়া যায় ওকিগাহারার জঙ্গলে। চলার পথে বেশ কিছু দ্রষ্টব্য স্থান রয়েছে, যেমন মোতোসু লেক, শোজি লেক ইত্যাদি। আরও কিছুটা এগোলে, শাইকো পক্ষী বন এবং আরও কিছু দূরে শাইকো লেক।
১৩৯ নম্বর রাজপথে চলার মধ্যেই ডানদিকে চোখে পড়বে গভীর অরণ্য। ওকিগাহারার জঙ্গলের ভিতরেই রয়েছে, ফুগাকু উইন্ড কেভ, নারুশাওয়া আইস কেভ। অনেকেই রোমাঞ্চকর অভিযানে যান এই সব এলাকা।
এতো গেল, মনোরম পরিবেশে ভ্রমণের কথা। রাজপথে চলার মাঝে অরণ্যের পাশে মাঝে মধ্যেই সাঁটানো রয়েছে বোর্ড। সবকটি জাপানি ভাষায় লেখা। বোর্ডে সতর্কবাণীর তলায় লেখা রয়েছে একটি ফোন নম্বর।

সতর্কবার্তায় বলা রয়েছে, অরণ্যে প্রবেশ নিষেধ, তবু কারও সাহায্যের প্রয়োজন হলে, ফোন করুন এই নম্বরে। আসলে এই সতর্কবাণীর পিছনে লুকিয়ে রয়েছে, এক কালো অধ্যায়। এ জঙ্গলে প্রবেশ করে অনেকেই পথ হারান, ফোন কাজ করে না। সিগন্যাল মেলে না। ফলে আনকোরা যাত্রীরা হারিয়ে যেতে পারেন এ জঙ্গলে। উদ্ধার করার কেউ নেই। এতো গেল সাধারণ পর্যটকের কথা।
আসল কাহিনি হল, এ অরণ্যে চিরদিনের জন্য হারিয়ে যেতে পা বাড়ান অনেকে। আত্মহত্যা করতে করতে। বহু মানুষ, যুবক, যুবতী এই অরণ্যের গভীরে গিয়ে আত্মহননের পথ বেছে নেন। তারা ফিরতে চান না, আধুনিক সভ্যতার তৈরি করা যান্ত্রিক জীবনে।
আত্মহত্যার জন্য শ্রেষ্ঠ পছন্দের জায়গা ওকিগাহারার জঙ্গল। বিষয়টি যখন প্রশাসনের নজরে আসে, তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। জঙ্গলের মধ্যে সারিবদ্ধ বহু গলাপচা ঝুলন্ত দেহ করে তারা।

তারপর থেকেই, রাজপথের পাশে দেওয়া হয়, সাইনবোর্ড। কিন্তু হতাশা, যন্ত্রণা কি সাইবোর্ডের কথা শোনে? না কখনই না, তবে দু একটা ঘটনা এমনও ঘটেছে, আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়ে অরণ্যে প্রবেশ করেছে, আবার মত বদলও করেছে, যদিও, অরণ্যের চক্রব্যুহে পথ হারিয়ে মৃত্যুকেই আপন করতে হয়েছে।
প্রশাসনের তদন্তকারী দলের কাছে এমনই ঘটনা নজরে এসেছে, জঙ্গলের মধ্যে প্রাপ্ত দেহ দেখে বুঝেছে, হয়তো আত্মহত্যার জন্য তারা এসেছিল, নেহাতই পথ হারিয়ে আর ফিরতে পারেনি। তারপর থেকে।
আরও পড়ুন- নির্জন নিরালায় বেড়াতে চাইলে ঘুরে আসুন
ওডিশার এই অফবিট জায়গা
জঙ্গলের মধ্যে লম্বা দড়িও ব্যবস্থা করেছে। জঙ্গলের বহু জায়গায় বিছোনো রয়েছে লম্বা দড়ি। সেই সূত্র ধরে মৃত্যু অন্ধকার চোরাগলি থেকে ফিরে আসা যায় জীবনের রাজপথে। কেউ কেউ ফিরে এসেছেন, আবার অনেকে ফিরে আসেননি।

জাপান আপাত দৃষ্টিতে শান্ত, দ্বন্দ্বহীন জীবনযাত্রার ছবি তুলে ধরলেও। এখানকার দ্রুত জীবনযাত্রাতেও হাতাশা আছে, দ্বন্দ্ব আছে। এখানেও রাতারাতি কর্মহীন হয়ে পড়েন মানুষ। আধুনিক সভ্যতার এক লহমায় ছুঁড়ে ফেলে দেয় অনিশ্চিত জীবনে। তখন তাদের পছন্দের জায়গা হয়ে ওঠে ওকিগাহারার জঙ্গল। অভিশপ্ত অরণ্য।
আরও পড়ুন- ভারতেই রয়েছে, পাহাড়ের কোলে লুকোনো এমন রহস্যময় জায়গা
এই অরণ্যকে ঘিরে স্থানীয় কিছু কিংবদন্তী ও লৌকিক গল্পও রয়েছে। অনেকে বলেন, একটা সময়ে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা এই জঙ্গলেই মহানির্বাণের জন্য সাধনা করতেন। এ জঙ্গলে আত্মহত্যার মন নিয়ে একবার এই জঙ্গলে প্রবেশ করলে, ফিরে আসার পথ প্রায় বন্ধ।