পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার জয়পুর অঞ্চলে অবস্থিত গোকুলচাঁদ মন্দির রাজ্যের অন্যতম বৃহৎ ও শৈল্পিক টেরাকোটা মন্দির। এই মন্দির শুধুমাত্র তার স্থাপত্যশৈলীর জন্যই নয়, বরং তার ইতিহাস ও জনশ্রুতির জন্যও প্রসিদ্ধ।
মন্দিরের ইতিহাস
গোকুলচাঁদ মন্দির ১৬৪৩ সালে মল্লরাজ রঘুনাথ সিংহ নির্মাণ করেন। মল্ল রাজবংশ বাংলার পশ্চিম প্রান্তে শক্তিশালী শাসক ছিলেন এবং তাঁরা বহু মন্দির নির্মাণ করেছিলেন।
এই মন্দিরটি রাধা-কৃষ্ণের মন্দির হলেও এখানে প্রধান দেবতা হিসেবে গোকুলচাঁদ (কৃষ্ণের এক রূপ) পূজিত হন। মল্ল রাজারা বৈষ্ণব ধর্মের প্রতি গভীরভাবে অনুগত ছিলেন এবং এই অঞ্চলে অনেক কৃষ্ণ মন্দির নির্মাণ করেছিলেন।
গোকুলচাঁদ মন্দিরটিকে “বাঁকুড়ার সর্ববৃহৎ পাথরের মন্দির” বলা হয়। এটি ৬৪ ফুট উচ্চতার এবং চতুর্দিকে টেরাকোটা শিল্পখচিত অলঙ্করণ রয়েছে।
জনশ্রুতি ও রহস্যময় কাহিনি
১. মন্দিরের বিগ্রহ গায়েব হয়ে যাওয়া
লোককথা অনুযায়ী, একসময় এই মন্দিরে একটি বিশাল কৃষ্ণমূর্তি ছিল, কিন্তু পরে সেটি হঠাৎই নিখোঁজ হয়ে যায়। অনেকে বলেন, মুর্শিদকুলী খানের শাসনকালে মূর্তিটি লুকিয়ে রাখা হয়েছিল।
২. অলৌকিক শক্তির উপস্থিতি
স্থানীয়দের বিশ্বাস, এই মন্দিরের আশেপাশে আজও অলৌকিক শক্তির অস্তিত্ব আছে। অনেক ভক্ত বলেন, রাতের বেলা কেউ যদি মন্দিরের প্রাঙ্গণে থাকে, তবে তারা বিভিন্ন রহস্যময় শব্দ শুনতে পান।
৩. গোপনে পূজা
একসময় মন্দিরে নিয়মিত পূজা হত, কিন্তু পরে নানা ঐতিহাসিক কারণে তা বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে বিশেষ উপলক্ষে এই মন্দিরে পুজো করা হয়।


স্থাপত্যশৈলী
গোকুলচাঁদ মন্দির পঞ্চরত্ন শৈলীতে নির্মিত। এর ভিতরের অংশটি লাল ইটের তৈরি এবং বাইরের অংশ জটিল নকশার টেরাকোটা কাজ দ্বারা অলংকৃত।
এই মন্দিরের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য—
✅ ৬৪ ফুট উচ্চতা – বাঁকুড়ার বৃহত্তম মন্দির
✅ পঞ্চরত্ন স্থাপত্য – পাঁচটি চূড়া বিশিষ্ট
✅ টেরাকোটা কারুকাজ – রামায়ণ ও মহাভারতের দৃশ্য চিত্রিত
✅ প্রাকৃতিক পরিবেশ – জয়পুর জঙ্গলের পাশে অবস্থিত
পর্যটকদের জন্য তথ্য
গোকুলচাঁদ মন্দির বর্তমানে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া (ASI) দ্বারা সংরক্ষিত।
কিভাবে যাবেন?
- বাঁকুড়া শহর থেকে জয়পুর ৩০ কিমি দূরে
- বাস বা গাড়িতে সহজেই পৌঁছানো যায়
সেরা সময় পরিদর্শনের
- দোলযাত্রা ও রথযাত্রা উপলক্ষে মন্দির প্রাঙ্গণে বিশেষ উৎসব হয়
উপসংহার
গোকুলচাঁদ মন্দির কেবলমাত্র ধর্মীয় উপাসনার স্থান নয়, এটি বাংলার টেরাকোটা স্থাপত্যের অন্যতম মূল্যবান নিদর্শন। ইতিহাস, লোককথা ও অলৌকিক কাহিনিতে ঘেরা এই মন্দির আজও ভক্ত ও পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু।
