উত্তরাখণ্ডের হিমালয়ের দুর্গম অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা কেদারনাথ, তুঙ্গনাথ, রুদ্রনাথ, মধ্যমাহেশ্বর এবং কল্পেশ্বর – এই পাঁচটি মন্দির একত্রে পরিচিত পঞ্চ কেদার নামে। এই মন্দিরগুলো ভগবান শিবের বিভিন্ন রূপের উপাসনার কেন্দ্র, যা মহাভারত এবং পুরাণে বর্ণিত পৌরাণিক কাহিনির সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত।
পঞ্চ কেদার মন্দিরের ইতিহাস ও পরিচয়
১. কেদারনাথ মন্দির
উপস্থিতি: রুদ্রপ্রয়াগ জেলার গাড়োয়াল হিমালয়ে, মন্দাকিনী নদীর তীরে।
ইতিহাস ও পৌরাণিক কাহিনি:
এটি বারোটি জ্যোতির্লিঙ্গের মধ্যে একটি এবং পঞ্চ কেদারের মধ্যে সর্বপ্রধান। কাহিনি অনুসারে, পাণ্ডবরা যখন কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পর পাপমোচনের জন্য শিবের দর্শন করতে যান, তখন শিব কেদারনাথে মহিষ রূপ ধারণ করে আত্মগোপন করেন। পাণ্ডবরা যখন শিবের সন্ধান পান, তখন তিনি মহিষ রূপে মাটির নিচে প্রবেশ করতে থাকেন, এবং তখন ভীম তার পিঠ ধরে ফেলেন। শিব তখন কেদারনাথে কুঁজো আকৃতিতে (হাম্প) প্রকাশিত হন, আর তার দেহের অন্যান্য অংশ অন্য চার কেদারে উদ্ভাসিত হয়।


২. তুঙ্গনাথ মন্দির
উপস্থিতি: রুদ্রপ্রয়াগ জেলার চোপতা অঞ্চলে, ৩,৬৮০ মিটার উচ্চতায় (পৃথিবীর সর্বোচ্চ শিব মন্দির)।
পৌরাণিক কাহিনি:
এখানে শিবের বাহু (হাত) পূজিত হয়। মনে করা হয়, পাণ্ডবদের মধ্যে অর্জুন এখানে তপস্যা করে শিবের আশীর্বাদ লাভ করেছিলেন।
৩. রুদ্রনাথ মন্দির
উপস্থিতি: চামোলি জেলার দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে।
পৌরাণিক কাহিনি:
এখানে শিবের মুখমণ্ডল (Face) পূজিত হয়। কথিত আছে, এই স্থানে শিবের দর্শন পাওয়া অত্যন্ত কঠিন, এবং এটি শুধুমাত্র প্রকৃত তপস্বীদের জন্য নির্ধারিত। এই মন্দিরে যাওয়ার পথটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর, যেখানে দেখা মেলে বিভিন্ন হিমালয়ী তৃণভূমি এবং বরফাবৃত শৃঙ্গ।
৪. মধ্যমাহেশ্বর মন্দির
উপস্থিতি: কেদারনাথের কাছাকাছি, ৩,৪৯০ মিটার উচ্চতায়।
পৌরাণিক কাহিনি:
এখানে শিবের নাভি (Mid-Torso) পূজিত হয়। কথিত আছে, পাণ্ডবদের মধ্যে ভীম এখানে কঠোর তপস্যা করেন এবং তার ফলস্বরূপ শিব এখানে প্রকাশিত হন।


৫. কল্পেশ্বর মন্দির
উপস্থিতি: উর্গম উপত্যকায়, চামোলি জেলায়।
পৌরাণিক কাহিনি:
এখানে শিবের জটা (Hair) পূজিত হয়। এটি পঞ্চ কেদারের মধ্যে একমাত্র মন্দির, যা সারা বছর খোলা থাকে। কথিত আছে, এখানে মহাদেব দুর্গম জঙ্গলে তপস্যা করেছিলেন এবং এটি ঋষিদের ধ্যানস্থানের জন্য বিখ্যাত।
পৌরাণিক প্রেক্ষাপট: পাণ্ডবদের শিবসন্ধান
মহাভারতের কাহিনি অনুসারে, পাণ্ডবরা কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে বহু মানুষ হত্যার কারণে নিজেদের পাপমোচনের জন্য শিবের আশ্রয় নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শিব তাদের দর্শন দিতে অস্বীকৃতি জানান এবং মহিষ রূপে হিমালয়ে লুকিয়ে পড়েন। পাণ্ডবরা তাকে খুঁজতে গেলে তিনি দেহের বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন স্থানে রেখে অদৃশ্য হয়ে যান। সেইসব স্থানে পঞ্চ কেদার মন্দির স্থাপন করা হয়।
উপসংহার
পঞ্চ কেদার শুধু শিবের উপাসনার স্থান নয়, এটি প্রকৃতি ও পৌরাণিক কাহিনির এক অপূর্ব সংমিশ্রণ। প্রতিটি মন্দিরই হিমালয়ের দুর্গম ও সৌন্দর্যমণ্ডিত অঞ্চলে অবস্থিত, যা তীর্থযাত্রীদের জন্য এক অনন্য অভিজ্ঞতা এনে দেয়। শিবভক্তদের জন্য এটি শুধু একটি তীর্থযাত্রা নয়, বরং এক আধ্যাত্মিক ও শারীরিক ধৈর্যের পরীক্ষা।
