Breaking News

খুব সহজে আমেরিকার নাগরিক হওয়ার পথ ‘ডঙ্কি রুট’- এক অজানা কাহিনি

পূর্ণেন্দু ব্যানার্জি- আমেরিকা, স্বপ্নের দেশ। একবার পৌঁছতে পারলেই একটা জীবন পরিপূর্ণ। অর্থ, আভিজাত্য, বৈভব, সামাজিক সম্মান কী নেই। বিশ্বের সেরা শক্তিশালী দেশের নাগরিক হওয়া মানে এক ভিন্নরূপী আভিজাত্য। কিছু মানুষের কাছে এই স্বপ্নপূরণ করা যতটা সহজ, বহু মানুষের কাছে তা অত্যন্ত কঠিন অকল্পনীয়।

সারা বিশ্বে যতগুলি দেশ রয়েছে, তার মধ্যে পশ্চিমীদেশগুলিতে যাওয়া কাজ করা সর্বপরি স্থায়ী নাগরিক হিসেবে জায়গা করে নেওয়ার স্বপ্ন অনেকের থাকে। কেউ সেখানে যাওয়ার জন্য কঠিন পরিশ্রম করেন, আবার কেউ কেউ এমন এক রাস্তা নির্বাচন করেন, যা ভয়ঙ্কর, প্রাণঘাতী। পাশাপাশি রয়েছে, বিপুল আর্থিক ক্ষতি ঝুঁকি।

গত কয়েক বছরে বহু ভারতীয় যুবক, পাড়ি দিচ্ছে আমেরিকার উদ্দেশে। স্রেফ স্থায়ী ঠিকানার সন্ধানে। কেউ যাচ্ছেন সোজা পথে, কেউ চোরাগোপ্তা পথে। সোজা পথে যেতে গেলে যেমন প্রয়োজন, শিক্ষা বা কোনও কাজের দক্ষতা, এবং কোনও আমেরিকান সংস্থার থেকে পাওয়া চাকরির অফার লেটার। তবে এই চাকরি করতে যাওয়া মানেই নাগরিকত্ব পাওয়ার কোনও গ্যারেন্টি নেই। আর এসব যাদের নেই, তাঁরাও বাঁকা পথে জীবন বাজি রেখে আমেরিকায় পাড়ি দেন ডঙ্কি ফ্লাইট ধরে।

কিন্তু কী এই ডঙ্কি ফ্লাইট

কাহিনীর শুরু হল, বহু এমন যুবক রয়েছে, যাঁরা আমেরিকায় যেতে চান স্থায়ী নাগরিকত্বের জন্য। আর সেই স্বপ্নকে রাস্তা দেখায় এক শ্রেণির এজেন্ট, যাঁরা  বিপুল অর্থের বিনিময়ে স্বপ্ন পূর্ণের রাস্তা তৈরি করে দেন। 

প্রথমে কাজের ভিসার লোভ দেখিয়ে ১০-১৫ হাজার টাকা নেওয়া হয়। সেই টাকা হাতানোর পরেই, তাঁদের পুলিশ ভেরিফিকেশন, ও নানাবিধ ডকুমেন্টের জন্য আরও টাকা আদায় করা হয়। সেটিও প্রায় ৩০-৪০ হাজারের কম নয়। যাদের টাকা নেই, তারা এই জায়গা তেই আটকে যায়। কিন্তু যাঁরা স্বপ্ন পূরণের জন্য, জীবন বাজি রাখতে প্রস্তুত হয়, তারা বাড়ি ঘর দোর সরকিছুই বাজি রাখে। দ্বিতীয় দফার টাকা পাওয়ার পরেই, এজেন্টরা তাদের আসল কথা বলতে শুরু করে। এবং কত টাকা আসলে খরচ পড়বে, কোথায় কোথায় পড়বে, সেই সম্পর্কে ধারণা দিতে থাকে। এখানেই অনেকে ভাবে, ৫০-৬০ হাজার যখন তারা খরচ করতে পেরেছে, আরও টাকা তারা খরচ করতে পারে।

যেহেতু আমেরিকা ইউরোপের ভিসা পাওয়া অতটা সহজ নয়, তাই এজেন্টরা, ল্যাটিন অমেরিকার দেশগুলির ভিসা জোগাড় করে দেয় তাদের। আর সেই দেশগুলির ডঙ্কি ফ্লাইটের মধ্যে সবচেয়ে দেশ হল ইক্যুয়াডোর। এই দেশেই আসার পর শুরু হয়, প্রথম দফার সংঘর্ষ। এখান থেকে এজেন্টরা, কলম্বিয়া, পানামা, কোস্টারিকা, নিকারাগুয়া, গুয়েতামালা হয়ে মেক্সিকো নিয়ে যায়। মেক্সিকোই হল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লাগোয়া দেশ।

এই যে কলম্বিয়া, থেকে মেক্সিকোর যাত্রা মোটের সহজ সরল নয়, কখনও, সাধারণ লোকযানবাহনে যেমন নিয়ে যাওয়া হয়, তেমনই, একটি দেশ থেকে অন্যদেশের সীমানায় ঢুকতে হলে, পার করতে হয়, জঙ্গল, পাহাড় নদী। প্রতিটি দেশের সীমান্ত কর্মীদের টাকা খাইয়ে, তবেই কাঁটাতার বা টিনের দেওয়ার পেরোতে হয়। কখনওবা জলপথেও যেতে হয় একটা দেশ থেকে আর একটা দেশে ক্যারিবিয়ান সাগর হয়ে। কখন কোন রুটে নিয়ে যাওয়া হবে, তা ঠিক করে এজেন্টরাই।

এখানে একটি কথা না বললেই নয়, ল্যাটিন আমেরিকার যে দেশগুলির কথা বললাম, সেগুলি প্রত্যেকটি অপরাদের দিক থেকে অত্যন্ত ভায়ঙ্কর দেশ। ড্রাগ পাচার, মানব পাচার, মানবদেহের অঙ্গ পাচার, লুঠ, খুন, ধর্ষণের বিশ্বের শীর্ষ তালিকায় রয়েছে। আমেরিকা নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে যমন বিশ্বাসী এজেন্ট রয়েছে, তেমনই রয়েছে, জাল এজেন্ট, তাদের খপ্পরে পড়লে, সব কিছুই যাবে। বিশেষ করে মানব অঙ্গ বিক্রির পর, দেহ ভাসিয়ে পুরোপুরি গায়েব করে দেওয়া হয়। যেহেতু এই রুটে বিদেশযাত্রা পুরোপুরি বেআইনি, তাই তাদের খোঁজ মেলাও দুষ্কর হয়ে পড়ে।

মেক্সিকো পৌঁছনোর পরেই শুরু হয়, আসল সংগ্রাম। ভারতসহ বিশের বহু দেশের নাগরিক মেক্সিকো থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে রওনা দেন ডঙ্কি ফ্লাইটের মাধ্যমে। মেক্সিকো ও মার্কিনযুক্তরাষ্ট্রকে বিভিক্ত করেছে একটি নদী নাম, রিও গ্রান্ডি।  আমেরিকায় পৌঁছতে হলে, এই নদীকে পার করতে হয়, আর তা দু’দেশের সেনাকর্মীদের চোখকে ধুলো দিয়ে। এই পথ মোটেই সুগম নয়, নাইলের পর মাইল হাঁটতে হয়, পেরতে হয়, পাহাড়, রাত কাটাতে হয় জঙ্গল।

সময় মতো এজেন্ট না এলে, কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত জঙ্গলের মধ্যেই অপেক্ষা করতে হয়। এই সময়, অভাব পড়তে পারে খাবার ও জলের। পরিসংখ্যান বলছে, প্রতি বছর এই মেক্সিকো রুট ধরে, যত মানুষ আমেরিকায় প্রবেশ করার চেষ্টা করে, তার ৫০ শতাংশ মানুষই মারা যান মার্কিন সীমান্তের প্রবেশের মুখে। বহু মানুষ দেশ ছাড়েন তাঁদের স্ত্রী সন্তানদের নিয়েও। বহু শিশুর মৃত্যু হয় পথের মধ্যে। গরম কালে, এখানকার আবহাওয়া এতোটাই অসহনীয় হয়ে ওঠে যে, তখন মৃত্যুই একমাত্র পথ হয়ে ওঠে।

চোরাগোপ্তা আশ্রয়ে মেক্সিকোতে বেশি দিন থাকা আরও ভয়ঙ্কর, কারণ, এই দেশটায় যেমন একটা পোশাকি সরকার আছে, তেমনই সমান্তরাল সরকার চালায় ড্রাগ মাফিয়ারা। এখানে সেনা ও পুলিশের থেকে বেশি গোলাগুলি খরচ করে মাফিয়াদের দল। মেক্সিকোতে একাধিক ড্রাগ মাফিয়ার গোষ্ঠী রয়েছে, তাদের উৎপাতে, প্রায়ই শহরে কার্যত কার্ফু চলে। জলজঙ্গলে তাদের দাপটতো রয়েইছে। ভারত থেকে এতোগুলো দেশ হয়ে এজেন্টদের টাকা দিতে দিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যখন পৌঁছনো যায়, তখন পকেট থেকে খসে যায়, অন্তত ৪০-৫০ লক্ষ টাকা।

এখন প্রশ্ন আসতেই পারে, কোনও ভাবে মার্কিন সীমান্তে একবার ঢুকে পড়লেই কি স্বপ্নপূর্ণ হয়ে যায়? না, আসলে একটি ছোট আইনের ফাঁককে ব্যবহার করেই স্থায়ী নাগরিকত্বের জন্য সহজে আবেদন করা যায়, যা সোজা রুটে কোনও কার্যত অসম্ভব। প্রশাসনিক সূত্রের খবর, অন্যান্য দেশে যেমন অবৈধ বা ইলিগাল মাইগ্রেন্ট বা অভিবাসন প্রত্যশী বলা হয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সেই শব্দ প্রয়োগ করা হয় না।

তাই বলা হয়, আন ডক্যুমেন্টেড এন্ট্রি। অবৈধ নয়। কারম কোনও ব্যক্তিইকে অবৈধ বাল যায় না। তাই তাঁদের পুলিশ নিয়ে যায়, ক্যাম্পে। সেখান থেকে কোর্টে পাঠানো হয়, বিচারে যদি প্রমাণ করা যায়, অত্যাচারিত হয়ে, তারা নিজেদের দেশ থেকে পালাতে বাধ্য রয়েছে নিজের ও পরিবারের নিরাপত্তা স্বার্থে, তাহলেই মেলে অ্যাসাইলামে থাকার সুযোগ। নয়তো, যে দেশের নাগরিক, সেই দেশে ফিরিয়ে দেওয়া বা ডিপোর্ট করার ব্যবস্থা করা হয়। তা করা হলে, সব স্বপ্ন শেষ।

আর অ্যাসাইলামে থাকার সুযোগ পেলে, ১৫০ দিনের সুযোগ থাকে, সাধারণ জব বা ছোট খাটো কাজ করার সার্টিফিকেট মেলার। এর জন্য স্থানীয় আইজীবীকেও জোগাড় করতে হয়, তারও খরচ রয়েছে। তারপর ধাপে ধাপে আইনানুগ প্রক্রিয়ার মধ্যে গেলে, একটা সময় মিলে যায়, স্থায়ী বসবাস ও চাকরির করার শংসাপত্র। তবে তার জন্য কিছু পড়াশুনা ও পরীক্ষাও পাস করতে হয়।

আমাদের চ্যানেলে যুক্ত হয়ে যান

About Orbit News

Check Also

manipur_news

জ্বলছে মণিপুর, অগ্নিগর্ভ করা হচ্ছে অত্যন্ত সুকৌশলে, সমাধানের রাস্তা লুকিয়ে কিছু সরল প্রশ্নে

স্বাতী চ্যাটার্জি– আপনাদের মহাভারতের খান্ডবন দহনের কথা মনে আছে? আছে হয়তো, তবু ছোট করে কয়েকটি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!