Breaking News

উইকেন্ডে দুটোদিন কাটিয়ে আসতে পারেন বাংলার ঐতিহাসিক জায়গা গৌড়

অবিভক্ত বাংলার ইতিহাস খুঁজলে একটা গৌরবজ্জ্বল অতীত মেলে। যদিও আজ তার বহুলাংশই হারিয়ে গিয়েছে সময়ের গর্ভে। সেই ইতিহাস ধরা রয়েছে স্রেফ বইয়ের পাতায় কালো হরফে। যদিও প্রাচীন কিছু প্রত্নতত্ত্বের নজির আজও দেখা যায়।

অনেকেই আছেন যাঁরা উইকেন্ড সফরে দার্জিলিং, দিঘা, পুরী ঘুরে আসেন। কেউবা বেড়িয়ে আসেন বাঁকুড়া, পুরুলিয়া। চাইলে দুটো দিন ইতিহাসের খোঁজে যেতে পারেন মালদায়। মালদা বলতেই, প্রথমে গৌড় এবং দ্বিতীয় জিনিস মাথায় আসে, আদিনা মসজিদের কথা। এই দুই এলাকায় প্রাচীন ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো দেখার জন্য রাজ্যের বিভিন্ন কোনা থেকে পর্যটকেরা আসেন।

দাখিল দরওয়াজা

দাখিল দরওয়াজা হল মালদার গৌড় শহরে অবস্থিত একটি মূল্যবান ঐতিহাসিক স্থাপত্য। ১৪২৫ খ্রিস্টাব্দে দাখিল দরওয়াজা নির্মিত হয়। সেই সময় গৌড় দুর্গের প্রধান প্রবেশদ্বার হিসাবে ব্যবহার করা হত এই সিংহ দরজাটিকে। এর শীর্ষে চার কোণে রয়েছে পাঁচতলা উঁচু টাওয়ার। দুর্গের প্রধান প্রবেশদ্বারটি ছাড়াও এটি চারপাশের বাঁধের মধ্য দিয়ে খোলে। অতিথি আপ্যায়ন বা কোনও শুভ কাজ উজ্জাপনের জন্য আগে এখান থেকে কামান দাগা হত। তাই এর আরও একটি নাম সালামি দরওয়াজা। বাংলায় মুসলিম শাসন আমলে নির্মিত এই প্রবেশদ্বারটির নির্মাণশৈলী ও বিশাল আকৃতির জন্য মালদায় দর্শনীয় স্থান হিসেবে এটি পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয়।

ফিরোজ মিনার

দাখিল দরওয়াজা থেকে মাত্র ১ কিলোমিটার দূরে রয়েছে ফিরোজ মিনার । গৌড়ের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ এই মিনার। দিল্লির কুতুব মিনারের আদলে এই মিনার তৈরি করেন সুলতান সৈফুদ্দিন ফিরোজ। সময়টা ১৪৮৬ থেকে ১৪৮৯ সালের মধ্যে। পাঁচতল বিশিষ্ট এই মিনারটির উচ্চতা প্রায় ২৫.৬০ মিটার এবং মোট তিয়াত্তরটি ধাপ রয়েছে।  সর্পিল সিঁড়ি পেরিয়ে এর শীর্ষে পৌঁছানো যায়। পোড়ামাটির নিখুঁত শিল্পশৈলীও লক্ষ্য করা যায় এই মিনারের দেওয়ালগুলিতে। এই ঐতিহাসিক স্থাপত্যটি পীর আশা মন্দির বা চেরাগদানি নামেও খ্যাত।

লুকোচুরি দরওয়াজা

মালদার অন্যতম দর্শনীয় স্থান লুকোচুরি দরওয়াজা। লুকোচুরি গেট বা লুকোচুরি দরওয়াজা কে নির্মাণ করেছিলেন তা নিয়ে নানা মুনির নানা মত রয়েছে। তবে অনেকের মত,  ১৬৫৫ সালে মুঘল সম্রাট শাহজাহানের পুত্র তৎকালীন বাংলার সুবেদার শাহ সুজা গৌড়ে এই শাহী দরওয়াজাটি নির্মাণ করেছিলেন। এখানেই নাকি তিনি বেগমের সঙ্গে লুকোচুরি খেলতেন, তাই নাম লুকোচুরি দরওয়াজা। আবার একাংশের মতে, এই স্থাপত্যটি ১৫২২ সালে আলাউদ্দিন হোসেন শাহ নির্মাণ করেছিলেন।

চিকা মসজিদ

গৌড়ের আরও একটি দর্শনীয় জায়গা হল চিকা মসজিদ। ১৪৭৫ খ্রিস্টাব্দে এই মসজিদটি সুলতান ইউসুফ শাহ গৌড়ে নির্মাণ করেছিলেন। তবে এই স্থাপত্যটি আদতে মসজিদ না সমাধিস্থল তা নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে গবেষকদের মধ্যেই। জনশ্রুতি রয়েছে সুলতান হুসেন শাহের আমলে এটি কারাগার হিসেবে ব্যবহার করা  হত। একটা সময় এই মসজিদ হয়ে ওঠে চামচিকেদের আশ্রয়স্থল, সেই থেকে মসজিদের লৌকিক নামকরণ হয় চিকা বা চামকান মসজিদ। মসজিদের কারুকাজ দেখলে বোঝা যায়, বহু হিন্দু মন্দির ভেঙে, তার ইট, পাথর ব্যবহার করে এটি তৈরি করা হয়।

রামকেলি                     

মালদা থেকে মাত্র ১৪ কিলোমিটার দক্ষিণে গৌড়ের পথে যেতে পড়ে রামকেলি গ্রাম। বৈষ্ণবদের কাছে এটি গুপ্ত বৃন্দাবন হিসেবে পরিচিত। এখানে রামকেলি মন্দিরে স্বয়ং চৈতন্যদেব এসেছিলেন বলে জানা যায়। তার পদচিহ্ন এখনও এখানকার একটি মন্দিরে রাখা আছ। রামকেলিতে রূপসাগর, শ্যামকুণ্ড, রাধাকুণ্ড, ললিতাকুণ্ড, বিষধাকুণ্ড, সুরভীকুণ্ড, রঞ্জকুণ্ড ও ইন্দুলেখাকুণ্ড এই আটটি কুণ্ড দ্বারা সেই পদচিহ্ন পরিবেষ্টিত আছে। এখানে প্রতিবছর জ্যৈষ্ঠ সংক্রান্তির দিন থেকে শুরু হয় রামকেলির বিশাল মেলা। পশ্চিমবঙ্গসহ বিভিন্ন জেলার পাশাপাশি বাংলাদেশ থেকেও ভক্ত দর্শনার্থীদের ভিড় জমে এই মেলায়। সারা দিন ধরে চলে কীর্তন। গ্রামবাসীদের মনোরঞ্জনের জন্য যাত্রাপালার আসর বসে।

বড় সোনা মসজিদ

রামকেলি গ্রাম থেকে মাত্র পাঁচশো মিটার দূরে গৌড়ে অবস্থিত বারোদুয়ারি বা বড় সোনা মসজিদ। এই বিশালাকার প্রাচীন মসজিদটি গৌড়ের বৃহত্তম স্থাপত্য। ইট এবং পাথরের তৈরি বিশাল আয়তাকার কাঠামোযুক্ত বৃহত্তম স্মৃতিসৌধের নামের অর্থ দ্বাদশ দরজা হলেও এখানে আসলে এগারোটি দরজা রয়েছে। আলাউদ্দিন হোসেন শাহের শাসন আমলে এই মসজিদটির নির্মাণকাজ শুরু হয়। ১৫২৬ সালে তাঁর পুত্র নাসিরুদ্দিন নুসরাত শাহের আমলে তা শেষ হয়। বারোদুয়ারি মসজিদে লক্ষ্য করা যায় ইন্দো আরবি স্থাপত্যশৈলীর ছোঁয়া। পাথরের উপর খোদাই করা ভাস্কর্য এখানকার প্রধান আকর্ষণ।

আদিনা মসজিদ

মালদায় দেখার মতো অন্যতম দ্রষ্টব্য হল। সুলতান সিকান্দার শাহের নির্মিত আদিনা মসজিদ। ১৩৬৯ সালে এই মসজিদটি তিনি নির্মাণ করেছিলেন। মসজিদটি সিরিয়ার রাজধানী দামাস্কাসে অবস্থিত উমাইয়া মসজিদের আদলে নির্মাণ করা হয়। ভারতের অন্যতম বৃহৎ মসজিদগুলির মধ্যে পাণ্ডুয়ার আদিনা মসজিদ অন্যতম। নাম উল্লেখযোগ্য। অষ্টম শতাব্দীতে নির্মিত এই মসজিদের নকশা বাংলা, আরব, ফার্সি ও বাইজেন্টাইন স্থাপত্য অন্তর্ভুক্ত

একলাখী সমাধিসৌধ

মালদার আদিনার ঠিক আগেই একলাখীতে অবস্থিত একটি সমাধি সৌধ যার এক নাম আছে গোলঘর। একলাখী সমাধিসৌধে মোট তিনটি সমাধি রয়েছে। অনুমান করা হয় এর মধ্যে একটি সমাধি রাজা গণেশের পুত্র জালালুদ্দিন মুহম্মদ শাহের এবং বাকী দুটি সমাধি তাঁর স্ত্রী ও পুত্র শামসুদ্দিন আহমদ শাহের। রাজা গণেশ ছিলেন দিনাজপুরের ভাতুরিয়ার জমিদার, তারপর তিনি নিজ ক্ষমতায় রাজা হয়ে গৌড়ের সিংহাসনে বসেছিলেন। তার ছেলে পরবর্তীকালে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং পিতা কে সরিয়ে নিজে ক্ষমতা দখল করেন।

সেই সময়ে এই সমাধিটি নির্মাণ করতে প্রায় এক লক্ষ টাকা খরচ হয়েছিল, তাই এটির এরকম নামকরণ করা হয়েছে। এই সুপ্রাচীন ঐতিহাসিক স্থাপত্যটি প্রাক-ইসলামী বাংলার ইঁটের তৈরি মন্দিরের অনুকরণে তৈরি করা হয়েছিল। এই সমাধিসৌধটির দেওয়াল গাত্রে রয়েছে অপরূপ পোড়ামাটির অলঙ্করণ।

জগজীবনপুর মহাবিহার

মালদা জেলার হবিবপুর ব্লকের বাংলাদেশ বর্ডারের খুব কাছেই জগজীবনপুর নামে একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান রয়েছে। পাল সম্রাট মহেন্দ্রপালদেবের একটি তাম্র ফলক শিলালিপি এই স্থান থেকে আবিষ্কৃত হয়েছিল। এছাড়াও এই স্থানে রয়েছে নবম শতাব্দীর একটি প্রাচীন বৌদ্ধ বিহারের নিদর্শন বেরিয়ে আসে, যাকে জগজীবনপুর মহাবিহার হিসেবে ডাকা হলেও এর নাম নন্দদির্ঘীকা উদ্রঙ্গ মহাবিহার।

এই বৌদ্ধ বিহার আবিষ্কার হওয়ার পর থেকে পাল আমলের ও রাজ বংশের অনেক অজানা ইতিহাস জানা যায়। এই স্থানটিতে অনেকগুলি ঢিবি রয়েছে, যেগুলির মধ্যে সর্ব বৃহৎ ঢিবিটির নাম তুলাঢিবি বা সালাইডাঙ্গা। এছাড়া আখড়িডাঙ্গা, নিমডাঙ্গা, নন্দনগড় ও রাজার মায়ার ঢিপি নামক আরও চারটি ঢিপি রয়েছে এখানে। এছাড়াও এখনও এখানে বিশাল এলাকা জুড়ে রয়েছে নন্দাদিঘি নামক একটি দীঘি।

জহুরা কালী মন্দির

তিনশো বছরের পুরোনো মালদার প্রাচীন জহুরা কালী মন্দির ভক্তদের মনে অত্যন্ত জাগ্রত। স্থানীয়দের অনেকের মতে এই মন্দিরের ইতিহাস প্রায় হাজার বছরের ও বেশী পুরনো। সেন বংশের রাজা বল্লাল সেনের আমলে এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠা বলে মনে করা হয়। এখানে কোনো মূর্তি পুজো হয়না, এখানে মায়ের মুখোস তৈরি করে পুজো করা হয়, যে মুখোস মালদা শহরেরই একটি পরিবার বংশানুক্রমিকভাবে করে চলছে।

এই মন্দির থেকে জায়গাটির নাম পরিচিত হয়েছে জহুরাতলা নামে। পুজো কেবলমাত্র মঙ্গল ও শনিবারেই হয়ে থাকে, বাকি দিনগুলিতে মন্দির বন্ধ থাকে। এই জহুরা কালী মন্দিরের পাশেই কিছুদূরে আরো একটি প্রাচীন মন্দির আছে যেটি একটি সূর্য মন্দির, অনেকে একে প্রাচীন জহুরা কালী মন্দির হিসেবেও মনে করে থাকে। আসলে অবশ্যই এই মন্দিরটিও দর্শন করে যাবেন।

মালদা জেলার সরকারি ওয়েবসাইট https://malda.gov.in/

আমাদের চ্যানেলে যুক্ত হয়ে যান

About Orbit News

Check Also

কম খরচে ঘুরে আসুন রাবণের দেশ শ্রীলঙ্কায়, রইল বিস্তারিত সফরসূচি পর্ব ২

পূর্ণেন্দু ব্যানার্জি পথের মাঝে সিগিরিয়ায় হোমস্টেতে ঢোকার আগে মধ্যাহ্নভোজ সেরে নেওয়া হল। এর পরেই হোমস্টে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!