পূর্ণেন্দু ব্যানার্জি– বর্ধমান জেলার বিখ্যাত জায়গা কালনা। অম্বিকা কালনা। এই জায়গার এক বিচিত্র ইতিহাস রয়েছে। আর তা জড়িয়ে রয়েছে বৈষণবধর্মের প্রবর্তক শ্রীচৈতন্যের সঙ্গে। গঙ্গার একদিকে শান্তিপুর আর এক দিকে কালনা।
শ্রীচৈতন্য কালনায় এসে তেঁতুলতলায় বসেছিলেন। সখানেই গৌরাদাসের সঙ্গে তাঁর মিলন হয়। সেই সময়টা মুসলিম যুগ। কিন্তু তারও আগে কি কালনার কোনও স্বতন্ত্র ইতিহাস ছিল? অম্বিকা কালনা এই অম্বিকা কে? কোথা থেকে এলেন?
বর্তমানে বাঙালিদের কাছে অম্বিকা হলেন দেবী দুর্গা। কিন্তু কয়েক শতক আগে দিকে ইতিহাসের পাতা ওল্টালে দেখা যাবে, অম্বিকা নামে জৈনধর্মীদের এক দেবী রয়েছেন। তাহলে কি জৈনদেবী ধর্মান্তকরণে হিন্দু দেবী হয়ে উঠেছেন?
কিছু গবেষক মনে করে, বর্ধমানের অম্বিকা কালনার অম্বিকাদেবী আসলে ছিলেন জৈনদেবী, পরে তিনি হিন্দুরূপে প্রকাশ পেয়েছেন। তাঁরা যে যুক্তি গুলি দিয়েছেন- জৈনদেবী অম্বিকার উপাসনা শ্বেতাম্বর ও দিগম্বর উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যেই দশম একাদশ থেকে ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতাব্দী পর্যন্ত প্রচলিত ছিল।
বিভিন্ন কর্মে দেবীর ভিন্ন রূপ দেখা দিত। যেমন শান্তির ক্ষেত্রে শ্বেতবর্ণ, বশ্যকর্মে পীতবর্ণ, মারণ উচাটনের ক্ষেত্রে রক্তবর্ণ। হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের তন্ত্রের ধারা একটা সময় প্রভাব ফেলেছিল জৈনদেরও, একাংশ গবেষকের এমনটাই মত।
ফলে অম্বিকার বিভিন্ন রূপের প্রভাব দেখা যায়। কখনও তিনি, দ্বিভূজা, চতুর্ভুজা, অষ্টভূজা। আবার কোথাও ২০টি হাতের অম্বিকা দেবীর দর্শনও মেলে। অম্বিকা সিংহবাহিনি হাতে আম্রপল্লব ও শিশু। চতুর্ভূজার ক্ষেত্রে দু হাতে আম্র্লুম্বি, একহাতে বরমুদ্রা ও এক হাতে শিশু। অষ্টভূজায়, শঙ্খ, চক্র, ধনু, খড়্গ, শস্য, আম্র্লুম্বি পাশ ইত্যাদি রয়েছে। বিংশভূজার হাতে, খড়গ, শক্তি, সর্প, ঢাল, কমণ্ডলু, পদ্ম, অভয় ও বরদমুদ্রা দেখা যায়।
বর্তমানে অম্বিকা কালনার অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন সিদ্ধেশ্বরী, চতুর্ভূজা কালীমূর্তি। সিংহবাহিনী দুর্গা নন। যদিও যেই কালী, সেই দুর্গা বাংলার মাটিতে এ তত্ত্ব মিলে মিশে গিয়েছে। এই অম্বিকা কালনা বৈষ্ণব কবিদের কাছে আম্বুয়া নামে পরিচিত ছিল।
ভাগীরথীর তীরে অম্বিকা যে হিন্দু সময়কালেও বেশ সমৃদ্ধ এলাকা ছিল, তার পুরাতত্ত্ব নিদর্শন মিলেছে। কালনায় মুসলিম আমলে যে কটি ঐতিহাসিক নিদর্শন রয়েছে, তার মদ্যে কয়েকটি মসজিদ আর দুর্গ প্রদান। প্রায় সবকটি মসজিদই তৈরি হয়েছিল, হিন্দু দেবালয়ের ভগ্নাবশেষ দিয়ে। বহু পাথরের টুকরোতে হিন্দু দেবদেবীর মূর্তি রয়েছে।
বর্ধমানের কালনার ইতিহাস বেশ ছড়ানো ও বর্ণময়, য়ার অধিকাংশ আজ বাংলার মানুষের কাছে গুরুত্বহীন হয়ে ওঠায়, সেভাবে প্রচার পায় না। বর্ধমানের জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় বেশ কিছু বিদ্যাস্থান প্রসিদ্ধ হয়ে উঠেছিল। তার মদ্যে অন্যতম অম্বিকা কালনা। সংস্কৃত ওশাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিতদের সমাবেশে অম্বিকা কালনা শীর্ষস্থানীয় হয়ে উঠেছিল।
কালনার পণ্ডিতদের মধ্যে বিখ্যাত ছিলেন তারানাথ তর্ক বাচস্পতি , শ্রীরাম ন্যায়বাগীশ, দুর্গাদাস ন্যায়রত্ন, অযোধ্যারাম বিদ্যাবাগীশ। তারানাথ তর্কবাচস্পতি ও তাঁর বংশের ইতিহাস অম্বিকা কালনার ইতিহাসে এক বড় অধ্যায় জুড়ে রয়েছে। তারানাথের পূর্বপুরুষরা যশোরের সারল গ্রামে বাস করতেন। সেই সময় যশোরের এই গ্রাম সংস্কৃত বিদ্যাচর্চার প্রধান সমাজ বলে গণ্য হত।
তারানাথের পুর্বপুরুষ রামরাম তর্কসিদ্ধান্ত বরিশাল জেলার বৈচণ্ডী গ্রামে বাস করতেন। বর্ধমানের রাজা তিলকচন্দ্র যখন অধিপতি হন, তখন দেশ বিদেশ থেকে বহু পণ্ডিতকে নিজের সভায় জায়গা দেন। সেই সময়ই কালনায় আসেন রামরাম তর্কসিদ্ধান্ত।
আরও পড়ুন–মহাশ্রীযন্ত্রের ব্যবহার কি কুসংস্কার? নাকি সত্যি এর কোনও শক্তি রয়েছে?
রামরাম তর্কসিদ্ধান্ত পূর্ববঙ্গ থেকে এসেছিলেন বলে, অম্বিকা কালনার স্থানীয়রা রামরামের উত্তরসূরিদের বাঙাল ভটচার্য বলে ডাকেন।
বিঃদ্রঃ আগামী দিনে আপনার এলাকার এমন প্রচীন ইতিহাস জানতে আজই আমাদের পেজ ফলো করুন।