Breaking News

রামরাজাতলার রামপুজোর লুকনো ইতিহাস- কেন সরস্বতী সবার উপরে থাকে?

পূর্ণেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়– প্রচীন বাংলার ইতিহাস ঘাঁটলে ধুমধাম করে, ঘটা করে রামপুজোর ইতিহাস খুব একটা চোখে পড়ে না। ব্যতিক্রম রামরাজাতলা। রামপুজোর বর্ণময় ইতিহাসের জেরে এলাকার নামই হয়েছে রামরাজাতলা।  যদিও অবাঙালিরা এখনও উচ্চরণ করেন রাজারামতলা।

হাওড়া এক বিচিত্র শহর। একসময় একে বলা হত, কুলিটাউন। পরে আলামোহন দাশের সৌজন্যে দাশনগরে শিল্পতালুক হওয়ার পর, এশিয়ার শেফিল্ড নাম কাড়ে। প্রচীন সময় থেকে হাওড়া জেলাতে প্রধান্য ছিল লৌকিক দেবদেবীর, চণ্ডী, কালী, শিব, দক্ষিণরায়, ক্ষেত্রপাল, চণ্ডীর আবার ভিন্নরূপ, মাকড়চণ্ডী, মেলাইচণ্ডী, ওলাইচণ্ডী ইত্যাদি তারা যদিও এখনও স্বমহিমায় অবস্থান করছেন।

ঐতিহাসিক গবেষকদের কাছে অনেক বেশি কৌতুহলের এমন একটা জায়গায় উত্তরভারতের দেবতা আচমকা রাম কীভাবে প্রভাব বিস্তার করলো।  ইতিহাস থেকে যেটুকু জানা যায়, আনুমানিক আড়াইশো বছর আগে স্থানীয় জমিদার  অযোধ্যারাম চৌধুরী  এই রামপুজোর প্রবর্তন করেন।

রামরাজার প্রতিষ্ঠা ও তাঁর উত্সবের জন্যই রামরাজাতলা জায়গার নাম।  আসল এলাকার নাম ছিল সাঁতরাগাছি, যদিও এখনও একটা অংশ জুড়ে সাঁতরাগাছি এলাকা রয়েছে।

অযোধ্যা চৌধুরীর গৃহদেবতা ছিলেন রাম। কিন্তু সেটা জনসমক্ষে কীভাবে ছড়িয়ে দেবেন তা নিয়ে তার মূর্তি কীরূপ হবে এমন কথা চিন্তা করতে করতেই স্বপ্ন দেখেন। স্বপ্নে দেখা রামসীতার মূর্তি বর্তমানের বাস্তব রূপ।

একটাতো একটা কাহানি, কিন্তু এর পিছনে রয়েছে আর এক কাহিনি, স্থানীয় কিছু বারেন্দ্র বাহ্মণের পরিবার একত্রে এলাকায় মহাধুমধামে সরস্বতী পুজো করতেন। পুজো উপলক্ষে মেলা বসত, প্রায় ১৫ দিন ধরে পুতুলনাচ, কীর্তন চলত। যা আজের দিনে সরস্বতীপুজোকে ঘিরে এমন আয়োজন নেই বললেই চলে।

অযোধ্যারামের রামপুজো প্রতিষ্ঠার পর শ্রীপঞ্চমীতে সরস্বতীপুজোর এই পুরনো ঐতিহ্যের একটা সংঘাত শুরু হল।  স্থানীয় প্রবীণদের মধ্যস্থতায় একটা আপস মীমাংসা হয়। সেখানে শুরু হয়, প্রতিবছর রামের পুজো হবে নবমী থেকে। তবে মূর্তি নির্মাণের শুভ উদ্বোধন হবে শ্রীপঞ্চমীর দিনে।  আরও একটি রফা হয়, বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি একই মঞ্চে থাকবে। স্থানীয় সালিশিতে ঠিক হয়, রামচন্দ্রসহ সমস্ত মূর্তির উপরে অধিষ্ঠান করবেন দেবী সরস্বতী। সেই ধারা অনুসারে এখনও সরস্বতী সবার উপরে থাকেন।

এই রামপুজোকে ঘিরে আরও এক ছোট বিতর্কও রয়েছে, তার প্রকাশ রয়েছে প্রচীন এক ছড়ায়, একাংশ গবেষকের মত, এই উত্সব আসলে জৈনদের ধর্মোত্সব।

-ন্যাংটা গোঁসাই মহাবীরের হাতে লাল নিশান ওড়ে, রং মেখে সং নড়ে চড়ে, তুড়ুক সওয়ার ঠ্যোকার করে। আহা মরি কি সভা হেরি শখের বাজারে।

এই ন্যাংটা গোঁসাইকে কিছু গবেষক মনে করেন ইনি রামভক্ত বীরহনুমান নন, জৈন তীর্থঙ্করদের মধ্যে কেউ হবেন।  যদিও বিপক্ষ গবেষকদের মত, হনুমানের নামও মহাবীর। আর বাঙালিরা ছোট ছেলেদেরও আদর করে ন্যাংটা গোঁসাই বলে ডাকেন। ফলে মহাবীর হনুমানকে বাঙালিরা আদর করে ন্যাংটা গোঁসাই ডাকতেন। ন্যাংটা মানেই যে জৈন তীর্থঙ্কর হতে হবে এমন কোনও মানে নেই।

আগেই বলেছি, এই রামপুজোর সূচনা করেছিলেন অযোধ্যারাম চৌধুরী। গবেষকদের মত, বাঙালিদের মধ্যে লাখে একজনের মধ্যেও অযোধ্যারাম হয় না। বরং নামটি অনেক বেশি জনপ্রিয় বিহার ও উত্তরপ্রদেশে।  অর্থাত্ এই অযোধ্যারাম উত্তরভারত থেকে যে নিজের ভাগ্যান্বেষণে এসে জমিদারি পেয়েছিলেন তা বোঝাই যায়।  যদিও এখনও তারা যে পুরোপুরি বাঙালি হয়ে গিয়েছেন তা বলাই বাহুল্য।

তবে রামরাজাতলার এই ইতিহাস থেকে আমরা যেটা পাই সেটা এক অদ্ভুত ইঙ্গিত পাই। এলাকায় রামপুজো চালু হলেও, আগে এখানে সরস্বতী পুজো হত। সেই জায়গায় রামের পুজো ধুম ধাম করে শুরু হয়। তবে স্থানীয় প্রাচীন ভাবাবেগকে সম্মান দিতে সরস্বতীকে সর্ব শীর্ষে জায়গা দেওয়া ও স্থানীয় লোকসংস্কৃতিকে মেনে নেওয়া বা আত্মসমর্পণেরই ইঙ্গিত।

আমাদের চ্যানেলে যুক্ত হয়ে যান

About Orbit News

Check Also

এই বাড়িতে রাখা আছে, কালো অধ্যায়ের স্মৃতি ‘দাহ হওয়া সতীর সিঁদুর’ কিন্তু কেন?

পূর্ণেন্দু ব্যানার্জি- ঘাটের কাছে মাঝিদের নৌকা ভেড়ানো বারণ হয়ে গিয়েছে। মণ্ডলবাড়ির এক কর্তা মারা গিয়েছেন। …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!